দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ এবং ফলাফল / দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রধান কারণ গুলি আলোচনা করো।
সূচনা:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র কুড়ি বছরের মধ্যেই আবার একটি বিশ্বযুদ্ধের সূচনা মানবজীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে অস্থির শান্তি পর্বের অবসানের পরিস্থিতি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি কর্তৃক পোল্যান্ড আক্রমণ ছিল বিশ্ববাসীর কাছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অশুভ সংকেত। আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে এই মারাত্মক পরিণতির জন্য বহুবিধ উপাদান দায়ী ছিল। সোভিয়েত ঐতিহাসিক ভ্লাদিমির আলেকজান্ড্রড বলেছেন—“দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংঘাত থেকে" (The Second World War broke out owing to the aggravation of the economic and political contradiction of imperialism)
*** পরোক্ষ কারণ:
1) ভার্সাই সন্ধির ত্রুটি :
ভার্সাই চুক্তিপত্রের ৪৪০টি ধারার বেশিরভাগ রচিত হয়েছিল জার্মানিকে স্থায়ীভাবে আর্থিক ও সামরিক দিক থেকে শক্তিহীন করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। জার্মানির সমরশক্তিকে বেলজিয়ামের মতো।
অতি ক্ষুদ্র দেশের থেকেও কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। জার্মানির উপনিবেশগুলি ভাগ করে নিয়েছিল মিত্রশক্তি।শুধু তাই নয় ভার্সাই চুক্তির দ্বারা জার্মানির ওপর বিশাল অঙ্কের ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে জার্মানি যুদ্ধমুখী হতে বাধ্য হয়েছিল।
[2] অতৃপ্ত আতীয়তাবাদ:
হিটলার চেয়েছিলেন পূর্ব ইউরোপে জার্মান সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটিয়ে জার্মানবাসীর জন্য লেকেনতাম বা বাসস্থানের সম্প্রসারণ ঘটাতে। এই অ জাতীয়তাবাদকে চরিতার্থ করতে নাতসিদলের তা দখলের মধ্যে দিয়ে জার্মানিতে প্রাক-বিশ্বযুদ্ধকালীন সামরিক তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছিল।
3. হিটলারের পররাষ্ট্রনীতি :
হিটলারের পররাষ্ট্রনীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল জার্মানিকে ইউরোপের প্রধান শক্তিতে পরিণত করা। হিটলার বারবারই নিজ কূটনীতি প্রয়োগের মাধ্যমে মিত্রশক্তিগুলির মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্বের সূচনা করেছিলেন এবং রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নকে এই ছোট থেকে পৃ করে ফেলতে সমর্থ হয়েছিলেন। অন্যদিকে হিটলার ফ্রান্স, পোল্যান্ড মৈত্রীতে ভাঙন ধরানোর জন্য ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে পোল-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করলে ইলা-ফরাসি জোট জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ই. এন. উভয়র্ড বলেন- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হিটলারের যুদ্ধ। তিনি এই যুদ্ধের পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি আরম্ভ করেছিলেন এবং শেষপর্যন্ত তিনিই পরাজিত হয়েছিলেন।
4) জাতীয়তাবাদ :
হিটলার মনে করতেন বিশ্বে একমাত্র জার্মানরাই বিশুদ্ধ আর্যরত্বের অধিকারী, তাই বিশ্বে জাতিগত দিক থেকে তারাই শ্রেষ্ঠ অর্থাৎ প্রভু জাতি বা হেরেনস্তক। এই কারণে অন্যান্য জাতির ওপর শাসন প্রতিষ্ঠা করার অধিকার রয়েছে জার্মানদের। হিটলারের এই হেলেনভক স্তর থেকে যে উগ্র সাম্রাজ্যবাদী নীতির জন্ম হয়েছিল, তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিল। চেকোশ্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড প্রভৃতি দেশে জার্মানির সুযোগমতো অধিকার স্থাপনের প্রচেষ্টা বিশ্বযুদ্ধকে নিশ্চিত করে তুলেছিল।
[5] জাপানের আগ্রাসী নীতি :
প্রাচ্য তথা এশীয় অংশে জাপানের ক্রম অগ্রগমন মিত্রশক্তির মনে আতঙ্কের সম্পরের ছিল। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে জাপানের মাঞ্চুরিয়া অধিকার তার সাম্রাজ্যবাদী নীতিরই পরিচায়ক।
6) ইতালির আগ্রাসন:
ইতালির আগ্রাসন ও পররাজ্যগ্রাম নীতি বিশ্বকে দ্রুত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়।ইতালি কর্তৃক আবিসিনিয়া অধিকারের কোনো প্রতিকার না হওয়ায় মুসোলিনির ক্ষমতা ও প্রভাব আরও বৃদ্ধি পায়, তাঁর আগ্রাসী মনোভাব বহুগুণ বেড়ে যায়।
7) দৃটি সামরিক শিবিরের স্বার্থসংঘাত:
ভার্সাই চুক্তির অব্যবহিত পরেই ফ্রান্স ও ইংল্যাণ্ডসহ মিত্রশক্তিজোট এবং জার্মানি, জাপান ও ইতালির অক্ষশক্তি জোটের মধ্যে বাণিজ্যিক, ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী সংঘাত বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনাকে বৃদ্ধি করেছিল। মুসোলিনির মতে—দুই জগতের এই দ্বন্দ্বে আপসের কোনো স্থান নেই হয় আমরা না করা।
[8] ইঙ্গ-ফরাসি তোষণ নীতি :
তোষণ নীতির দ্বারা ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স পশ্চিম ইউরোপের বদলে পূর্বে রাশিয়ার দিকে হিটলারের অবাধ সম্প্রসারণ চেয়েছিল। কারণ ওইসব ধনতন্ত্রী দেশগুলির কাছে নাৎসি জার্মানি বা ফ্যাসিবাদী ইতালির চেয়ে সমাজতন্ত্রী রাশিয়া ছিল অনেক বেশি বিপজ্জনক। তাই ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স চেয়েছিল হিটলারের জার্মানি ও মুসোলিনির ইতালিকে দিয়ে সোভিয়েত সাম্যবাদকে ধ্বংস করতে। কিন্তু এই তোষণ নীতি হিংলোর তথা একনায়কদের শক্তিই শুধু বৃদ্ধি করেনি, তাদের আগ্রাসী মনোভাবকে তীব্র করে তুলেছিল। এ. কে. পি. টেলকো মতে—ইঙ্গ-ফরাসি তোষণ নীতি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ।
9) আদর্শগত দ্বন্দ্ব:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়কালে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলি আদর্শগত দিক থেকে পরস্পরবিরোধী দুই শিবিরে ভাগ হয়ে যায়। একদিকে ছিল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি গণনা রাষ্ট্র। অপরদিকে ছিল ইতালি, জাপান, জার্মানি ও স্পেন প্রভৃতি স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্র। আবার সোভিয়েত রাশিয়াতেসাম্যবাদী আদর্শ দ্বারা পরিচালিত সরকার। এদের বিভিন্ন আদর্শের দ্বন্ধ বিশ্বের রাজনৈতিক ভারসাম্যকে বিঘ্ন করে। আন্তর্জাতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি করে যুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি করে।
[10] সমাজতান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক ভাবধারার সংঘাত :
সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে ধনতান্ত্রিক ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের বারংবার ভুল বোঝাবুঝি ও পারস্পরিক সন্দেহপ্রবণতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে। হিটলার অনাক্রমণ চুক্তি দ্বারা রাশিয়াকে নিষ্ক্রিয় রাখলেও ইংল্যান্ডের দুর্বল নীতি যুদ্ধ ডেকে আনে।
[II] বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে বিশ্বজুড়ে যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছিল, তার ফলে বিশ্ববাণিজ্য ও শিল্পায়ন প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়ে। বিভিন্ন দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি চরমে পৌঁছোয়। বেশ কিছু দেশ এই সমস্যার থেকে দেশবাসীর মুখ ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য যুদ্ধে যোগ দেন।
[12] ঔপনিবেশিক লড়াই:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ভার্সাই চুক্তির অধিকার বলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আমেরিকা বিশ্বের বেশিরভাগ উপনিবেশগুলি দখল করে নেয়। অপরদিকে ইতালি, জার্মানি ও জাপান দেরিতে হলেও নতুন নতুন উপনিবেশ দখলের কর্মসূচি গ্রহণ করে। ইতালি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে উপনিবেশ বিস্তারে সচেষ্ট হলে ইঙ্গ ফরাসি স্বার্থে আঘাত লাগে। আবার জাপান প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রভাব বাড়াতে চাইলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শঙ্কিত হয়ে পড়ে। এভাবেই ঔপনিবেশিক স্বার্থসংঘাত যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করে। জার্মানির বিদেশমন্ত্রী রিবেনট্রপ বলেছিলেন—জার্মানি উপনিবেশ বিস্তারের অধিকারকে এক মৌলিক অধিকাররূপে দাবি জানাচ্ছে (Germany claims a fundamental right to colonial possession)।
[13] নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনের ব্যর্থতা:
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে লিগের তত্ত্বাবধানে জেনেভায় নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন আহুত হয়। এই সম্মেলনে সমবেত প্রতিনিধিবর্গ সংকীর্ণ দেশীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বক্তব্য রাখতে পারেননি। তাই শেষ পর্যন্ত জার্মানি এই সম্মেলন ছেড়ে চলে যায়। এই সম্মেলনের ব্যর্থতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল। জাতিসংঘের চুক্তিপত্রের অষ্টম ধারায় উল্লিখিত ছিল—শান্তিরক্ষার্থে চুক্তিবদ্ধ সকল সদস্যরাষ্ট্রের আত্মরক্ষার প্রয়োজনের সঙ্গে সংগতি রেখে যতদূর সম্ভব অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কিন্তু জাতিসংঘের কোনো সদস্যরাষ্ট্রই তা না মানায় যুদ্ধ ত্বরান্বিত হয়।
14) জাতিসংঘের ব্যর্থতা :
লিগ বৃহৎ শক্তিবর্গের অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে দ্বিধান্বিত ছিল। ফলে বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তার রক্ষক হিসেবে সদর্থক ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়। ইতালির আবিসিনিয়া অধিকার, জাপানের মাঞ্চুরিয়া অধিকার এবং জার্মানির চেকোশ্লোভাকিয়া দখলের প্রতিকার করতে লিগ ব্যর্থ হয়। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘটিত হয়।
প্রত্যক্ষ কারণ—হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণ :
রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষশক্তি গঠন হওয়ার পর হিটলার পোল্যান্ডের রাষ্ট্রসীমার মধ্যে দিয়ে ডানজিগ অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগের জন্য একটি সংযোগ ভূমি বা পোলিশ করিডর দাবি করেন। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড এই ঘোষণার বিরোধিতা করে পোল্যান্ডের পক্ষ নেবে বলে হুমকি দেয়। এই হুমকিকে নস্যাৎ করে দিয়ে হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করে বসেন (১৯৩৯ খ্রি., ১ সেপ্টেম্বর)। এর দুদিন পর (৩ সেপ্টেম্বর) ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স পোল্যান্ডের পক্ষে যোগ দিলে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
উপসংহার :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য যুদ্ধরত দুই পক্ষের কূটনৈতিক ব্যর্থতাও কম দায়ী নয়। ইতালিতে ফ্যাসিবাদ, জার্মানিতে নাৎসিবাদ ও জাপানে জঙ্গিবাদের উত্থান বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তাকে বিপন্ন করলেও গণতান্ত্রিক দেশগুলি তা রক্ষার জন্য কোনো উদ্যোগই নেয়নি।
0 Comments
If you like the posts, you must comment. and if there is any problem , please let me know in the comments.