সোভিয়েত ইউনিয়ন কেন ভেঙে যায়। / সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের কারণগুলি বিশ্লেষণ করো।

 সোভিয়েত ইউনিয়ন কেন ভেঙে যায় ? / সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের কারণগুলি বিশ্লেষণ করো।

ভূমিকা: 

বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন ও শেষপর্যন্ত তার বিলুপ্তি আজও ঐতিহাসিকদের আলোচনার বিষয়। বলশেভিক বিপ্লবের (১৯১৭ খ্রি.) মাধ্যমে রাশিয়ায় জারতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে বিশ্বে প্রথম যে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করেছিল, তা প্রায় পঁচাত্তর বছরের মধ্যেই বিলুপ্ত হল (২৬ ডিসেম্বর, ১৯৯১ খ্রি.)। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন শুরু হয় গর্বাচভের আমলে আর এই ভাঙন সম্পূর্ণ হয় বরিস ইয়েলৎসিন রাষ্ট্রপতি থাকাকালে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন কেন ভেঙে যায়। / সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের কারণগুলি বিশ্লেষণ করো।


সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের কারণ:

[1] একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসন : 

সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির জন্য একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসন অনেকাংশে দায়ী ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট পার্টি সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় তৎপর হয়। সর্বহারার একনায়কত্বের বদলে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্যক্তি ও দলের একনায়কত্ব। ফলে দল ও সরকারের মধ্যে কোনো পার্থক্য না থাকায় শাসনব্যবস্থায় জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো প্রতিফলনই ছিল না। এইভাবে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সোভিয়েতে যে 'লাল স্বৈরাচার' (Red Bonapartism) প্রতিষ্ঠিত হয়, তা সোভিয়েতের পতনকে নিশ্চিত করে দেয়।


[2] দুর্বল অর্থনীতি :

 কট্টর সাম্যবাদী শাসনাধীনে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বেহাল অবস্থা সোভিয়েত অস্তিত্বকে, বিপন্ন করে তোলে। O সোভিয়েত ইউনিয়নে গড় জাতীয় আয়ের ত্রিশ শতাংশই ব্যয় হত সামরিক বিভাগে। পুঁজির অভাবে ভোগ্যপণ্য ও শিল্প উৎপাদন মার খায়। যার পরিণামে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ব্যাহত হয়। 2 কৃষি ও শিল্পে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণের ফলে দেশীয় সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার না হওয়ায়জনগণের মাথাপিছু আয় কমে যায়। 3) লেনিনের নয়া অর্থনৈতিক নীতি বা NEP (New Economic Policy) বাতিল করে স্টালিন কৃষিকাজে যে বাধ্যতামূলক যৌথ চাষ ব্যবস্থার প্রচলন করেন তাতে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি কৃষকদের দুর্দশাও চরমে পৌঁছায়।


[3] শিল্পক্ষেত্রে সংকট: 

সোভিয়েত ইউনিয়নে পরিকল্পিত অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকরণ না হওয়ায় কৃষির মতো শিল্পক্ষেত্রেও সংকট দেখা দেয়। শিল্পক্ষেত্রে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগের ফলে সম্পদের অপচয়, অদক্ষতা ইত্যাদি উৎপাদন ক্ষেত্রে এক গভীর সংকট সৃষ্টি করে। শিল্পজাত পণ্য সামগ্রীর অভাব সাধারণ মানুষকে অস্থির ও অসহায় করে তুলেছি।

4) সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ : 

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের অন্যতম একটি কারণ ছিল। কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, এমনকি বিজ্ঞানীরও চিন্তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হত। প্যাস্টারনিক, সোলঝেনিৎসিনের মতো সাহিত্যিক, সাধারভের মতো বিজ্ঞানী প্রমুখ সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সমালোচনা করেছিলেন বলে তাদেরকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। সরকারের এই ভূমিকা সোভিয়েতের পতনে অনুঘটকের কাজ করেছিল বলা চলে।

[5] প্রশাসনিক সংকট : 

রাষ্ট্রের অর্থনীতির ওপর পার্টির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বনাশই ডেএনেছিল।  প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে চূড়ান্ত কেন্দ্রীকরণের ফলে অলসতা, পরিশ্রমবিমুখতা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা দেশকে সর্বনাশের পথেই টেনে নিয়ে যায়। ও অপরিণামদর্শী আমলাদের খেয়ালখুশিমতো আদেশ-নির্দেশে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অধিক গুরুত্ব আরোপ করা ।


[6] রাষ্ট্রীয় কাঠামোগত ত্রুটি: 

সোভিয়েত ইউনিয়নের কাঠামোগত কিছু ত্রুটির জন্য বিভিন্ন জাতির সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে আশা-আকাঙ্ক্ষা নানা সময়ে নানাভাবে দমিত হয়ে এসেছেআসলে রাশিয়াতে জারতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে বলশেভিকতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ঘটলেও পূর্বতন জার সাম্রাজ্যের কাঠাঅনেকটা বজায় ছিল। স্টালিনের আমল পর্যন্ত সোভিয়েত সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আধুনিকীকরণের ও উদারীকরণের প্রচেষ্টা না থাকায় সোভিয়েত ইউনিয়নের পুরাতন কাভেঙে অঙ্গরাষ্ট্রগুলি একে একে বেরিয়ে আসে।

7 )গর্বাচভের দায়িত্ব: 

গর্বাচভের নতুন নীতি অর্থাৎ পুনর্গঠন (পেরেস্ত্রোইকা) ও মুক্তচিন্তার (গ্লাসনস্ত) নীসো ভিয়েত শাসনব্যবস্থায় যে খোলা বাতাসের অনুপ্রবেশ ঘটায়, তা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন জাতির। এতদিনের অবদমিত আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করার সুযোগ এনে দেয়। গর্বাচভ উদারীকরণের রাস্তায় হাঁটায় সোভিয়েত রাশিয়ায় পুঁজিবাদের লক্ষণ ফুটে ওঠে। গর্বাচভ 'গ্লাসনস্ত' ও 'পেরেস্ত্রোইকা' নীতি গ্রহণ করায় সোভিয়েত রাশিয়ায় নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির প্রচুর প্রার্থী পরাজিত হয়। গর্বাচভের গৃহীত নীতি শেষপর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনকে ত্বরান্বিত করে।

৪) কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব : 

সোভিয়েত কমিউনিস্ট দলেভেতরকার দ্বন্দ্ব ক্রমশ দলকে দুর্বল করে তোলে। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দ থেকেই সোভিয়েত রাজনীতি দুই পরস্পর বিপরীত মেরুতে ভাগ হয়ে গেল। বরিস ইয়েলৎসিন, আলেকজান্ডার ইয়াকভলেভ, এডওয়ার্ড শেভারনাদজে প্রমুখ ২৮তম পাটি সম্মেলনে (১৯৯০ খ্রি. জুলাই) কমিউনিস্ট দলকে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দলে রূপান্তরের প্রস্তাব রাখেন। অপরদিকে ইগার লিগাচেত. ভি. আই. ভারোতনিকভ প্রমুখের প্রচেষ্টায় এক রক্ষণশীল গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে। দলীয় কোন্দলে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ঐক্য ও শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। সেই সুযোগে বিভিন্ন অঙ্গরাষ্ট্র সোভিয়েত রাষ্ট্রীয় সংহতিকে বিপন্ন করে তোলে।

9 )আধিপত্যবাদী বিদেশনীতি: 

সাম্যবাদের প্রসার ও পুঁজিবাদের বরিস ইয়েলৎসিন বিরোধিতার নামে সোভিয়েত বিদেশনীতি অতিমাত্রায় আগ্রাসী ও আধিপত্যবাদী হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়কালে পূর্ব ইউরোপ সহ বেশ কিছু দেশে রুশআধিপত্যের বিস্তার ঘটানো হয়। শুধু তাই নয়, রোমানিয়া, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেকোশ্লোভাকিয়া সহ বেশ কিছু দেশের সরকার ফেলে দিয়ে সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। সোভিয়েত কর্তৃত্ববাদে অতিষ্ট হয়ে এই সকল দেশের অধিবাসীরা রুশ মনোনীত সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এর পরিণামে ওই সকল দেশের সোভিয়েত মনোনীত সরকারের অবসান ঘটে। সোভিয়েত প্রভুত্ববাদের এই অবসানের প্রভাবে খোল সোভিয়েত ইউনিয়নেও শাসনব্যবস্থার ভিত আলগা হয়ে পড়ে।


10) সেভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্তির তাত্ত্বিক ব্যাখা:

 সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পেছনে উল্লিখিত কারণগুলি ছাড়াও কিছু তত্ত্বগত দিকের কথা কেউ কেউ স্মরণ করিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন—( I )কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জাগরণের কোনো চেষ্টা করেননি; (ii)এ ছাড়াও ও গর্বাচভের বাজার অর্থনীতির ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ; (iii)সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টিতে গণতন্ত্রের অভাব: (iv)সর্বক্ষেত্রেই কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের জন্য কম দায়ী নয়


উপসংহার :

 বরিস ইয়েলৎসিনের নেতৃত্বে বিরোধী গোষ্ঠীর সক্রিয় বিরোধিতার কাছে হার মেনে অবশেষে গর্বাচভ সোভিয়েত কমিউনিস্ট দলের সাধারণ সম্পাদকের পদে ইস্তফা দেন (১৯৯১ খ্রি., ২৪ আগস্ট)। অবশেষে একটি একটি করে সরকটি অঙ্গরাষ্ট্র স্বাধীনতা ঘোষণা করে ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসায় বিলুপ্তি ঘটে সোভিয়েত ইউনিয়নের ।



Post a Comment

0 Comments