জাপানের একুশ দফা দাবি কি | কবে কোন দেশ চীনের ওপর 21 দফা দাবি | ঐতিহাসিক একুশ দফা দাবির প্রথম দাবি কি ছিল | ২১ দফা গুলো কি কি | ২১ দফা কর্মসূচির মুখ্য রচয়িতা কে | ২১ দফা কত সালে হয় |Japan's twenty one point demands?
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে জাপানি সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারে এক সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিল। ইংল্যান্ডের মিত্র হিসাবে জাপান ১৯১৪ সালের ২৩ আগস্ট জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। ইংল্যান্ড প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত জার্মান নৌবহরকে ধ্বংস করার জন্য জাপানের সাহায্য চেয়েছিল ঠিক কথা, কিন্তু সে দূরপ্রাচ্যে জাপানের দ্রুত অগ্রগমনকে মানতে পারেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনসহ অন্যান্য পাশ্চাত্য শক্তিগুলো ইউরোপে জীবন-মরণ সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। এশিয়া সম্পর্কে তাদের কোনো মোহ সেইসময় ছিল না। পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে ছিল জাপান। ইউরোপের শক্তিগুলোর অবর্তমানে জাপান প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে নিজের প্রভাব বাড়িয়েছিল। তাকে বাধা দেওয়ার মতো কোনো শক্তি তখন ছিল না। যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে জাপান সমগ্র পূর্ব এশিয়ার উপর তার আধিপত্য বিস্তারের পরিকল্পনা করেছিল।
অন্য পোস্ট : চীনের আত্মশক্তি আন্দোলন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় চীনের পরিস্থিতি খুব জটিল ছিল। চীনে সমরনায়কেরা ক্ষমতাশালী হয়ে বিভিন্ন প্রান্তে নিজেদের ক্ষমতাকে বাড়িয়েছিল। চীনে প্রজাতন্ত্র তখন দুর্বল হয়ে কোনোরকমে টিকে ছিল। চীন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রথমদিকে নিরপেক্ষ ছিল। জাপান চীনের দুর্বলতার সুযোগ নিতে চেয়েছিল। জাপান চীনে জার্মান প্রভাবাধীন এলাকা দখল করার জন্য সৈন্য পাঠিয়েছিল। সে কিয়াও-চাও (Kiao Chaw) বন্দর দখল করেছিল এবং শানটুং উপদ্বীপে অবস্থিত জার্মান এলাকাগুলো দখল করেছিল। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে কয়েকটি জার্মান অধিকৃত দ্বীপও জাপানের অধিকারে এসেছিল। এইসব এলাকাকে দখল করার সময় জাপান ভণ্ড-তাপসের মতো বলেছিল যে উপযুক্ত সময়ে সে চীনের হাতে এইসব এলাকাকে ফিরিয়ে দেবে কিন্তু বাস্তবে সে ইচ্ছা তার আদৌ ছিল না।
এরপর জাপান প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় অবস্থিত জার্মান উপনিবেশ মার্শাল ও ক্যারোলিন দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সুযোগে জাপান ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার মতো তার সাম্রাজ্যের সীমাকে বহুদূর বিস্তৃত করতে পেরেছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী জাপানের সাম্রাজ্য ক্ষুধা এতে মেটেনি। জাপান চীনেরওপর তার নিয়ন্ত্রণকে দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ১৯১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি তার কুখ্যাত ২১ দফা দাবি পেশ করেছিল। এই দাবিগুলোকে মেনে নেওয়া চীনের পক্ষে সম্ভব কিনা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চীনকে মাত্র ৪৮ ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়েছিল। এই দাবিগুলোকে পাঠানো হয়েছিল তখনকার চীনা রাষ্ট্রপতি ইউয়ান-সি কাই-এর কাছে। তাকে এই দাবিগুলিকে গোপন রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এই দাবিগুলি যদি গোপন থাকে এবং চীনা রাষ্ট্রপতি যদি সেগুলো মেনে নেন তাহলে জাপান তার লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার সুযোগ পাবে। পাশ্চাত্যের শক্তিবর্গ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যস্ত ছিল এবং তারা এশিয়াতে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আগ্রহী ছিল। তাই জাপানের মনে হয়েছিল তারা জাপানের দাবিগুলোকে মেনে নেবে। জাপানের ২১ দফা দাবি গোপন থাকেনি।
জাপান তার দাবি আদায়ের জন্য চীনের ওপর দু ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছিল : (১) চীনা রাষ্ট্রপতি ইউয়ান-সি কাই-কে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। চীনকে বলা হয়েছিল জাপানের এই দাবিগুলো না মানলে চীনের সঙ্গে যুদ্ধ করা হবে। অর্থাৎ জাপান চীনকে সামরিক ভয় দেখিয়েছি।(২) চীনা রাষ্ট্রপতি ইউয়ান-সি-কাই রাষ্ট্রপতি থেকে চীনা সম্রাট হওয়ার বাসনায় বিভোর ছিলেন। ডাঃ সান-ইয়াৎ-সেন তাঁর হাতে চীনা প্রজাতন্ত্রকে সমর্পণ করেছিলেন। কিন্তু ইউয়ান সানের মর্যাদা রাখেননি। তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। তিনি প্রজাতন্ত্রকে শক্তিশালী না করে তাকে ধ্বংস করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অবশ্য তাঁর কাজকে সাধারণ চীনা জনগণ মেনে নিতে পারেনি। তারা ইউয়ানের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল। জাপান এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে চেয়েছিল। জাপান ইউয়ানের সম্রাট হওয়ার ইচ্ছায় রসদ নিয়েছিল। তাকে টোপ দিয়ে বলা হয়েছিল যদি তিনি জাপানের ২১ দফা দাবি মেনে নেন, তাহলে জাপান তাঁকে সব ধরনের সাহায্য করে তাঁর স্বপ্ন পূরণ করে দেবে। অর্থাৎ ইউয়ানকে জাপান চীনা সম্রাট হিসাবে বসাবে। ইউয়ান জাপানের এই টোপে ধরা দিয়েছিলেন। তাঁর কাছে তখন চীনের জাতীয় স্বার্থ নয়, নিজের স্বার্থপূরণ অনেক জরুরি ছিল।
চীনের ওপর আরোপিত জাপানের ২১ দফা দাবিকে ৫ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সেগুলি হল :
১. শানটুং অঞ্চলে জাপানের প্রাধান্য সংক্রান্ত দাবি।
২. দক্ষিণ মাঞ্চুরিয়া ও পূর্ব অন্তর্মঙ্গোলিয়া সংক্রান্ত দাবি। ৩. চীন থেকে কয়লা ও লৌহ শিল্প সংক্রান্ত সুযোগ সুবিধার দাবি।
৪. চীনের উপসাগর, বন্দর, তীরবর্তী দ্বীপ ইত্যাদি হস্তান্তরিত না করার দাবি।
৫.চীনের অভ্যন্তরীণ শাসনের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের ওপর জাপানের নিয়ন্ত্রণদাবি।
এই দাবিগুলোকে সামান্য বিশ্লেষণ করা দরকার। শানটুং সংক্রান্ত দাবি প্রসঙ্গে জাপানের বক্তব্য ছিল যুদ্ধ শেষে জাপান এই ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত নেবে তা চীনকে মেনে নিতে হবে। আসলে জাপান এই অঞ্চলকে নিজের অধিকারে রাখতে চেয়েছিল। এখানকার বন্দর, খনি ও রেলপথকে জাপান নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছিল।
অন্য পোস্ট: চীনা কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার পটভূমি
জাপানের উপনিবেশ হিসেবে এবং জাপানের মূলধন বিনিয়োগের উৎস হিসেবে মাঞ্চুরিয়াকে ব্যবহার করা হবে। অন্তর্মঙ্গোলিয়াকে জাপানে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। দক্ষিণ মাঞ্চুরিয়া ও অন্তর্মঙ্গোলিয়ার রেলপথের ওপর জাপানি ইজারার সময়সীমা ছিল ২৫ বছর অর্থাৎ এই সময়সীমা শেষ হওয়ার কথা ছিল ১৯২৩ সালে। জাপান চীনের কাছে দাবি করেছিল এই ইজারা ১৯ বছর করতে হবে। জাপানের আরও দাবি ছিল ঐসব অঞ্চলে যেসব জাপানি বসবাস করছে তাদের নানাবিধ সুযোগ সুবিধা যেমন বসবাসের সুযোগ, ব্যবসা করার সুযোগ, জমি কেনার সুযোগ, কৃষি ও শিল্পে অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ ও খনি খননের সুযোগ দিতে হবে। ঐ অঞ্চলে জাপানের সম্মতি ছাড়া অন্য কোনো দেশ রেলপথ নির্মাণ করতে পারবে না। জাপানের মঙ্গোলিয়া ও মাঞ্চুরিয়া সংক্রান্ত দাবি মানার অর্থ ছিল ঐ অঞ্চল দুটিতে জাপানের প্রভাব বৃদ্ধি, চীনের সার্বভৌমত্বের অবসান এবং মুক্তদ্বার হওয়া। নীতি ব্যর্থ হওয়া।
অন্য পোস্ট: মেইজি মেইজি রেস্টোরেশন পটভূমি / মেইজি রেস্টোরেশন প্রকৃতি
জাপান কর্তৃক উত্থাপিত তৃতীয় গুচ্ছ দাবির অর্থ ছিল চীনের কয়লা ও লোহার উৎসগুলোকে জাপানের নিয়ন্ত্রণে আনা। হ্যান-ইয়ে-পিং নামে এক কোম্পানি চীনে করলা ও লোহার খনিগুলোকে পরিচালনা করত। আপান পরি করেছিল এই কোম্পানিকে এবং চীনের লোহা ও কয়লা খনিগুলোকে চীন-জাপানের যৌথ প্রকল্পে আনতে হবে। জাপানের দাবি ছিল জাপানের সম্মতি ছাড়া হ্যান-ইয়ে-পিং কোম্পানির কোনো অধিকার হস্তান্তর করা যাবে না। এই কোম্পানির আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। জাপান তাদের ঋণ দিয়েছিল। জাপানের অঙ্গুলি হেলনে চলা ছাড়া তাদের কোনো উপায় ছিল না।
অন্য পোস্ট: আফিং-এর যুদ্ধে লিন্-সে-সুর ভূমিকা
জাপানে চতুর্থ গুচ্ছর দাবি ছিল চীন যেন কোনো উপসাগর, বন্দর, উপকূলবর্তী কোনো দ্বীপ ইত্যাদি বিদেশিদের অর্পণ না করে এবং ইজারা না দেয়। এই দাবির পিছনে জাপানের আসল উদ্দেশ্য ছিল চীনের দরজাকে বিদেশিদের সামনে বন্ধ করে দেওয়া। জাপানের এই দাবিকে এশিয়াতে মনরো নীতির প্রয়োগ বলা চলে।
চীনের কাছে জাপানের পঞ্চম গুচ্ছের দাবি ছিল সবচেয়ে মারাত্মক। জাপানের দাবি ছিল চীনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক বিভাগে জাপানি উপদেষ্টা নিয়োগ করতে হবে। চীনের কয়েকটি শহরে যৌথভাবে চীনা জাপানি পুলিশ প্রশাসন নিয়োগ করবে। জাপান আরও দাবি করেছিল চীনের প্রয়োজনীয় সমর উপকরণের ৫০ শতাংশ জাপান থেকে কিনতে হবে। চীনে একটি অস্ত্রাগার নির্মাণ করতে হবে।
চীন ও জাপানের যৌথ নিয়ন্ত্রণে তা পরিচালিত হবে। তবে এর বিশেষজ্ঞ হবেন একজন জাপানি। চীনের অভ্যন্তরে জাপানিদের অনেক সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। তাদের হাতপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য, ধর্মকেন্দ্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় জমি দিতে হবে। ফরমোসার বিপরীত দিকে অবস্থিত ফুকিয়েনের উন্নতির জন্য জাপানের পরামর্শ ছাড়া কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা যাবে না। জাপানের এই পঞ্চম গুচ্ছের দাবি মানার অর্থ ছিল চীনের সার্বভৌমত্ব বিনাশ হওয়া।
চীনের ওপর আরোপিত এই ২১ দফা দাবি ছিল নিঃসন্দেহে অপমানজনক। আসলে জাপান পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে চেয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য ইউরোপীয় শক্তিগুলি ব্যস্ত ছিল। তাদের পক্ষে জাপানকে বাধা দেওয়া কিংবা চীনকে রক্ষা করা সম্ভব ছিল না। এই পরিস্থিতি থেকে চীনের মুক্তি ছিল না। চীন এই দাবিকে প্রত্যাখ্যানও করেনি কিংবা মানেওনি। চীনা রাষ্ট্রপতি ইউয়ান-সি-কাই ২১ দফা দাবির গোপনীয়তা ভঙ্গ করেছিলেন। এই দাবিগুলো প্রকাশ পেলে চীনে প্রচণ্ড গণঅসন্তোষ ও বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। জাপান চীনকে চাপ দেওয়ার জন্য ১৯১৫ সালের ৭ মে এক চরমপত্র প্রেরণ করেছিল। এই চিঠির বক্তব্য ছিল জাপানের দাবি না মানলে যুদ্ধ অনিবার্য। যুদ্ধের ইঙ্গিত স্বরূপ রণতরী ও যুদ্ধ জাহাজের জলছাপ এঁকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। চীনের সাধারণ জনগণ জাপানের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিল এবং ৭ ও ৯ মে “জাতীয় অবমাননা” দিবস হিসাবে পালন করেছিল।
চীনা রাষ্ট্রপতি জাপানের চিঠি পেয়ে বিপদে পড়েছিলেন। ইউয়ান-সি কাই-এর পক্ষে জাপানের দাবিকে অগ্রাহ্য করা কিংবা মানা সহজ ছিল না। ব্যক্তিগতভাবে তিনি চীনের সম্রাট হতে চেয়েছিলেন। জাপানের বক্তব্য ছিল যদি তিনি তাদের দাবিকে মেনে নেন তাহলে জাপান তাঁর স্বপ্ন পূরণের জন্য সাহায্য করবে। ইউয়ান সি-কাই সম্রাট হওয়ার বাসনায় বিভোর ছিলেন। স্বাভাবিক কারণে তিনি অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর পঞ্চম গুচ্ছের দাবিগুলো বাদে অন্য দাবিগুলোকে মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ১৯১৫ সালের মে মাসে তাঁর সঙ্গে জাপানের দুটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চীন জাপানের প্রধান চারটি দাবিকে মেনে নিয়েছিল। পঞ্চম গুচ্ছের দাবি পরে মেনে নেওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। যে যে দাবিগুলোকে মেনে নিয়েছিল তার মধ্যে ছিল জাপান শানটুং প্রদেশটি নিজের দখলে রাখবে, কোয়াংটুং প্রদেশে আপানের ইজারার মেয়াদ ১৯ বছর করা হবে। দক্ষিণ মাঞ্চুরিয়ায় জাপান রেলপথ ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা পাবে। ভবিষ্যতে ফুকিয়েন প্রদেশে বিদেশি মূলধন বিনিয়োগ বা রেলপথ স্থাপনের ক্ষেত্রে জাপানের সঙ্গে পরামর্শ করা হবে। চীনের ওপর জাপানের প্রভুত্ব কায়েম হয়েছিল তা সহজেই বলা যায়। ইঙ্গ-জাপ চুক্তি থাকা সত্ত্বেও জাপানের এই আগ্রাসী মনোভাবকে ইংল্যান্ডপছন্দ করেনি। ইংল্যান্ডের মনে হয়েছিল বেলজিয়ামের সঙ্গে জার্মানির আচরণের থেকেও জাপানের আচরণ আরও নিন্দনীয় ছিল।
জাপান চীনের ওপর যে ২১ দফা দাবি চাপিয়েছিল তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে বিতর্ক থাকাই স্বাভাবিক। জাপান চীনের ওপর ২১ দফা দাবি চাপিয়ে সঠিক কাজ করেনি। জাপানের দাবিগুলি ছিল নৈতিক ও মানবতার আদর্শ বিরোধী দৃষ্টান্ত। এই দাবিগুলি পেশ করে জাপান তার নির্লজ্জ সাম্রাজ্যবাদের নগ্ন প্রকাশ ঘটিয়েছিল। ব্রিটিশমন্ত্রী স্যার জন জর্ডন জাপানের আগ্রাসনের নিন্দা করেছিলেন। তিনি জাপানের কাজকে জার্মানির থেকেও নিন্দনীয় বলে মনে করেছিলে
সাধারণ চীনা জনগণ জাপানের সাম্রাজ্যবাদী আচরণকে মানতে পারেনি। চীনের নানা জায়গায় জাপান বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল। জাপানি পণ্যকে বয়কট করা হয়েছিল। জাপান বিরোধী গণ আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছিল। এই আন্দোলন পরিচালনা করার জন্য National Salvation নামে একটি অর্থভাণ্ডার গঠন করা হয়েছিল। এই অর্থ ভাণ্ডারে সকল শ্রেণীর মানুষ সাহায্য দিয়েছিল। জাপান বিরোধী আন্দোলনে চীনা ছাত্রদের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল। ১৯১৯ সালের ৪ মে এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছিল। জাপানি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে চীনে এক নতুন ইতিহাস রচিত হয়েছিল। সারা দেশে এক অভূতপূর্ব উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছি
জাপানের অভ্যন্তরেও প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছিল। জাপানে কাতোর প্রবল সমালোচনা শুরু হয়েছিল। চীনে ব্যাপক জাপ বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে ইয়ামাগাতা বিরক্ত হয়ে কাতোকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিলেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জাপানের ভাবমূর্তি অনেকটাই ম্লান হয়েছিল। জাপান যখন চীনের কাছে তার দাবি পেশ করেছিল তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল চীনের পক্ষে সহানুভূতিসম্পন্ন রাষ্ট্র। সে চীনের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে রক্ষা করার কথা বলেছিল। স্বাভাবিক কারণে চীনের ওপর জাপানের ভূমিকাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানতে পারেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের বিরোধিতা করেছিল। তারা Open door policy-র সমর্থক ছিল। কিন্তু জাপান চীনে এই নীতি মানতে চায়নি। সে কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর জাপানের ২১ দফা দাবির সমালোচনা করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপান ও চীনকে জানিয়েছিল যে ২১ দফা দাবির ভিত্তিতে যদি কোনো চুক্তি তারা স্বাক্ষর করে তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে মানবে না। মার্কিনি ও জাপানিদের সম্পর্কের অবনতির ক্ষেত্রে ২১ দফা দাবি যে অন্যতম কারণ ছিল তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় মুখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের বিরোধিতা করলেও বাস্তবে তার ভূমিকা অন্যরকম ছিল। মার্কিন বাণিজ্য স্বার্থ ক্ষুণ্ণ না হলে যুক্তরাষ্ট্র জাপানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে পদক্ষেপ নেয়নি। ইঙ্গ-জাপ চুক্তি থাকা সত্ত্বেও জাপানের ভূমিকাকে ব্রিটেন মানতে পারেনি। লন্ডনে জাপানি দূতকে সতর্ক করে বলা হয় যে কাতো অনেক বাড়াবাড়ি করছে। কিছুদিন পর ইঙ্গ-জাপ চুক্তির যে অবসান হয়েছিল তার পিছনেও চীনের ওপর চাপানো ২১ দফা দাবির ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না।
অন্যদিকে অনেকের বক্তব্য হল জাপান যে ২১ দফা দাবি চীনের ওপর পেশ করেছিল তার জন্য তাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সাম্রাজ্যবাদের নীতিই হল সুযোগের সদ্ব্যবহার করা। জাপান তার ব্যতিক্রম ছিল না। আসলে জাপান তার শিল্প ও অর্থনীতির স্বার্থে এই ধরনের দাবি চীনের ওপর পেশ করেছিল। জাপান শিল্পনির্ভর এক পুঁজিবাদী দেশে পরিণত হয়েছিল। শিল্পের জন্য যে সব উপাদানের প্রয়োজন। বিশেষ করে কয়লা ও লোহার অভাব জাপানে ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানে শিল্পের বিকাশ শুরু হয়েছিল। তাই জাপান শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল বিশেষ করে কয়লা ও লোহা সংগ্রহের জন্য চীনের ওপর দাবি জানিয়েছিল। সে সময় এশিয়ায় চীন ছিল প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। লোহা ও কয়লায় অফুরন্ত সম্পদে সমৃদ্ধ ছিল চীন। এছাড়া চীন ছিল বিশ্বের অন্যতম জনবহুল রাষ্ট্র। চীনের বিশাল বাজার জাপানকে আকৃষ্ট করেছিল। তাই সঠিকভাবে অনেকের বক্তব্য চীনের ওপর জাপানের ২১ দফা দাবি যতটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য দ্বারা চালিত।
অন্য পোস্ট: পাবনার কৃষক বিদ্রোহ
জাপানের ২১ দফা দাবি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বাস্তবে দেখা গেছে যে চীনের ওপর জাপানের প্রভাব ছিল অপরিসীম। জাপান পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের সঙ্গে এই প্রসঙ্গে আলোচনা করেছিল। সে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি, রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো নিজেদের স্বার্থে চলেছিল। চীনকে রক্ষা করার তাগিদ তাদের ছিল না। তারা চীনের ওপর জাপানের প্রভাবকে মেনে নিয়েছিল। জাপান যে পরিকল্পিতভাবে সাম্রাজ্যবাদী নীতি অনুসরণ করে চীনকে তার নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে সফল হয়েছিল তা বলা চলে।
0 Comments
If you like the posts, you must comment. and if there is any problem , please let me know in the comments.