ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলন :
ব্রাহ্ম সমাজের পথিকৃৎ ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। ১৮২৮ সালে যখন তিনি ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তখন কিন্তু তাঁর একটি স্বতন্ত্র ধর্মমত বা ধর্ম সম্প্রদায় গঠন করার কোন উদ্দেশ্য ছিল না। হিন্দুধর্মের মধ্যে থেকেই তিনি ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের কাজে ব্রতী হ'য়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অক্ষয়কুমার দত্ত ব্রাহ্ম সমাজের নেতৃত্ব দেন। বেদের অভ্রান্ততা ও একেশ্বরবাদের উপর জোর দিয়ে দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম আন্দোলনকে ক্রমশঃ এক চরমপন্থী ও বৈপ্লবিক চরিত্র দান করেন। একদল তরুণ ব্রাহ্ম বাল্য বিবাহ, বহু বিবাহ, কুলীন প্রথা প্রভৃতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করে এবং বিধবা বিবাহ ও নারী মুক্তির পক্ষে জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলে ব্রাহ্ম আন্দোলনে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেন। এই অবস্থায় ১৮৫৭ সালে কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্ম সমাজে যোগদান করার সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্ম সমাজের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় “ব্রাহ্ম সমাজে সেটা মধ্যাহ্ন কাল কেশবের প্রভাবে সমাজ এক নতুন মূর্তি ধারণ করলো। কেশবের আগমনে আমাদের জীবনে নবজীবনের সঞ্চার হলো।”
অন্য পোস্ট: পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে খ্রিস্টান মিশনারীদের ভূমিকা
কেশবচন্দ্র সেনের (১৮৩৮–৮৪) জন্ম হ'য়েছিল নিষ্ঠাবান এক বৈষ্ণব পরিবারে। তাঁর ধমনীতে ছিল বৈষ্ণবসুলভ নম্রতা ও ভক্তি। হিন্দু কলেজের ছাত্র কেশবচন্দ্র সেন দর্শন শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন ঐ কলেজের অধ্যাপক জোন্সের কাছে। ছাত্রজীবনে তাঁর প্রিয় লেখকদের মধ্যে ছিলেন রীড়, হ্যামিলটন, মোরেল, থিয়োডোর পার্কার, এমারসন ও মিল্টন। বাংলা ও সংস্কৃত সাহিত্যেও তাঁর দখল ছিল। বেদ ও গীতা ছিল তাঁর প্রিয় গ্রন্থ। ভারতীয় দর্শন ও ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। বৈষ্ণব পরিবারে জন্ম হলেও তিনি আকৃষ্ট হ'য়েছিলেন খৃষ্টধর্মে এবং Old Testament তাঁকে জুগিয়েছিল মানসিক খাদ্য। অন্যদিকে রামকৃষ্ণের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসে তিনি তাঁর আধ্যাত্মিকতার আদর্শে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি ব্রাহ্ম আদর্শে আকৃষ্ট হ'য়েছিলেন রাজনারায়ণ বসুর লেখা What is Brahmoism ? পড়ে। ১৮৫৭ সালেতিনি ব্রাহ্ম সমাজে যোগদান করলেও তাঁর ধর্মচিন্তা ও আদর্শ গড়ে উঠেছিল নানা ধর্মমতের সমন্বয়ে। তিনি নিজেই একটি বক্তৃতায় এ কথা স্বীকার করেছিলেন - "The Lord Jesus is my will, Socretes my head, Chaitanya my heart, the Hindu Rishi my soul and the philanthropic Howard my right hand,"
ব্রাহ্ম সমাজে যোগদান করার সঙ্গে সঙ্গেই কেশবচন্দ্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের নজরে পড়েন। মহর্ষি তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ হন। ১৮৬২ সালে তিনি আচার্য পদে অভিষিক্ত হন। তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের প্রথম অব্রাহ্মণ আচার্য। ব্রাহ্ম সমাজে যোগদান করার পর কেশবচন্দ্র নব্যবঙ্গ আন্দোলনের তাৎপর্য্য মূল্যায়ণ করে এর সীমাবদ্ধতাগুলি "Young Bengal, This is for you" (১৮৬০) নামে নিবন্ধে তুলে ধরেন। তাঁর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হ'য়ে বহু যুবক ও ছাত্র ব্রাহ্ম সমাজে যোগদান করে। কেশবচন্দ্রের আদর্শ ছিল মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ধর্মীয় ভাব ও চেতনার পুনরুজ্জীবন ঘটানো এবং রামমোহন প্রবর্তিত ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের কাজ অব্যাহত রাখা। তিনি জোর দিয়েছিলেন নৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রগতির উপর। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে, বিশেষতঃ নারী শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে, অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদ প্রথার অবলুপ্তি ঘটিয়ে ও বিভিন্ন সামাজিক কু-প্রথার অবসান করে তিনি এক সামাজিক বিপ্লব আনতে চেয়েছিলেন। বস্তুত ব্রাহ্ম সমাজে যোগদান করার আগেই তিনি বিভিন্ন সমাজকল্যাণ মূলক কাজে নেতৃত্ব দেন। ১৮৫৫ সালে তিনি বয়স্কদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য কলকাতার কলুটোলায় একটি নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৫৯ সালে জনমত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি বিধবা বিবাহের উপর উমেশচন্দ্র দত্তের লেখা একটি নাটক (বিধবা বিবাহ নাটক) মঞ্চস্থ করান। ১৮৬২ সালে “Destiny of Human life" শীর্ষক এক বক্তৃতায় তিনি বললেন——অস্পৃশ্যতা মনুষ্যসৃষ্ট একটি ব্যাধি। ১৮৬১ সালে তিনি একটি অত্যন্ত লোভনীয় সরকারী চাকরি ছেড়ে সমাজ সেবার কাজে মন দেন। ঐ বছর উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে দুর্ভিক্ষ কবলিত লক্ষ লক্ষ মানুষকে সাহায্য দান করার জন্য তিনি এক অর্থ ভাণ্ডার গড়ে তোলেন। কেবলমাত্র বক্তৃতা ও আলাপ আলোচনার মধ্যেই তিনি তাঁর আন্দোলন সীমায়িত রাখেন নি। ব্রাহ্ম সমাজের নেতৃত্বে তিনি ১৮৬২ সালে প্রথম অসবর্ণ বিবাহের উদ্যোগ করেন এবং ১৮৭২ সালে সরকারকে দিয়ে ব্রাহ্ম বিবাহ আইন বিধিবদ্ধ করান। এই আইনই ১৮৭২ সালের তিন আইন নামে পরিচিত হয়। এর ফলে বহু বিবাহ ও বাল্য বিবাহ নিষিদ্ধ হয় ও অসবর্ণ বিবাহ স্বীকৃতি হয়। স্ত্রী শিক্ষা বিস্তার ও নারীমুক্তি আন্দোলন জোরদার করার উদ্দেশ্যে তিনি ১৮৬২ সালে ‘ব্রাহ্ম বন্ধু সভা' প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৬৪ সালে তিনি মহিলাদের জন্য 'বামা বোধিনী পত্রিকা' নামে একট মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৮৭০ সালে প্রকাশিত হয় 'পরিচারিকা'। ১৮৬৫ সালে তিনি ব্রাহ্ম মহিলাদের জন্য 'ব্রাহ্মিকা সমাজ' নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ১৮৭১ সালে তিনি Native Ladies Normal School স্থাপন করেন। অন্যদিকে বৃত্তিমূলক শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে তিনি ১৮৭০-৭১ সালে একটি শিল্প বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। জনগণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের পক্ষপাতি ছিলেন। জন সাধারণের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেবার জন্য তিনি এক পয়সার বিনিময়ে 'সুলভ সমাচার' নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। মাত্র দু-মাসের মধ্যে এই পত্রিকার গ্রাহক সংখ্যা ৮০০০-এ গিয়ে দাঁড়ায়। মদ্যপানের বিষময় ফল প্রত্যক্ষ করে তিনি জনমত গড়ে তোলার জন্য “মদ না গরল” নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করেন। ১৮৬১ সালে তিনি দেবেন্দ্রনাথের আর্থিক সাহায্যে “Indian Mirror” নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকাটি এত জনপ্রিয় হয় যে ১৮৭১ সালে তা দৈনিক পত্রিকায় পরিণত হয়। এই সব পত্র পত্রিকার মাধ্যমে কেশবচন্দ্র তাঁর সংস্কারমূলক কাজকর্ম চালিয়ে যান। অধ্যাপক চিত্তব্রত পালিত যথার্থই বলেছেন "Journalism was never put to such extensive use for social amelio ration before Keshab. In his hands, the press became a national platform of supreme importance."
সমাজ সংস্কার ও শিক্ষা প্রসারে কেশবচন্দ্রের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় হলেও তিনি ছিলেন মূলতঃ একজন ধর্ম প্রচারক এবং ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনে প্রথম ভাঙ্গন ধরে তাঁরই নেতৃত্বে। তিনি একই সঙ্গে খৃষ্টান মিশনারী ও রক্ষণশীল ব্রাহ্মদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হ'য়েছিলেন। ১৮৬৩ সালে রেভারেও লালবিহারী দের নেতৃত্বে যখন খৃষ্টান মিশনারীরা ব্রাহ্ম সমাজকে আক্রমণ করে, তখন তিনি “Brahma Samaj Vindicated” নামক একটি পুস্তিকায় তার যোগ্য প্রত্যুত্তর দেন। ১৮৬৬ সালে স্কট মনক্রিয়েফ নামে জনৈক এ্যাঙ্গলো ইন্ডিয়ান বণিক ভারতীয় সংস্কৃতি ও চরিত্রকে কটাক্ষ করে একটি বক্তব্য রাখেন। এর উত্তরে কেশবচন্দ্র Jesus Christ : Europe and Asia শীর্ষক এক বক্তৃতা দেন। এই ভাষণে ভারতীয় চরিত্র ও ইউরোপীয় চরিত্র বিশ্লেষণ করে স্কটের বক্তব্যের জোরালো প্রতিবাদ করলেও তিনি যীশুখৃষ্টের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাঁর ক্ষমা ও আত্মোৎসর্গের মহান আদর্শের কথা উল্লেখ করেন। এর ফলে অনেক শিক্ষিত বাঙালী তাঁর উপর অসন্তুষ্ট হন। আসলে কেশবচন্দ্রের উদার ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গী অনেকেরই মনঃপুত ছিল না। রক্ষণশীল ব্রাহ্ম নেতারা ব্রাহ্ম আদর্শকে কেবলমাত্র উপনিষদের শিক্ষার উপর নির্ভরশীল বলে মনে করলেও কেশবচন্দ্র ও তাঁর অনুগামীরা ব্রাহ্ম আন্দোলনকে প্রসারিত করার জন্য অন্যান্য সামাজিক আদর্শ ও চিন্তাধারা গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন। ভাবাবেগের পরিবর্তে যুক্তিবাদী ও সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে ব্রাহ্ম আন্দোলনে নতুন প্রাণ আনতে এইসব তরুণ নেতা ঝাঁপিয়ে পড়লেন। দেবেন্দ্রনাথ ও অন্যান্য রক্ষণশীল ব্রাহ্ম নেতারা হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিকতায় বিশ্বাস না করলেও হিন্দু ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বে নবীন ব্রাহ্ম নেতারা হিন্দু ধর্মের জাতিভেদ, বাল্য বিবাহ, বহু বিবাহ, উপবীত ধারণ, পর্দাপ্রথা প্রভৃতি মানতে অস্বীকার করেন। সর্বপ্রকার সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বে বিদ্রোহী ব্রাহ্মরা বললেন — “Brahmoism is catholic and universal. ব্রাহ্ম সমাজের সংগঠন, উপাসনা পদ্ধতি প্রভৃতি লৌকিক আচরণ বিধি নিয়ে দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে কেশবচন্দ্রের তীব্র মতবিরোধ দেখা দেয়। কেশবচন্দ্রের আদর্শ ছিল এক ঈশ্বর, এক সংগঠন, এক আচরণ বিধি ও এক মানবধর্ম। তিনি যে “শ্লোক সংগ্রহ” বা ধর্মীয় শিক্ষা ও আদর্শ প্রচার করেছিলেন, তার মধ্যে বাইবেল, কোরাণ ও জেন্দা ভেস্তের বাণী সংকলিত হ'য়েছিল। প্রেম ও ভ্রাতৃত্বের এই সর্বজনীন আবেদন রক্ষণশীল ব্রাহ্মদের ভালো লাগে নি। অন্যদিকে হিন্দুদের অনুকরণে খোল করতাল সহযোগে শোভাযাত্রা করে নাম সংকীর্তণ প্রবর্তন করেও কেশবচন্দ্র রক্ষণশীল প্রবীন ব্রাহ্ম নেতাদের বিরাগভাজন হন। ভক্তির প্রাবল্য ও শক্তি মতাদর্শের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ব্রাহ্ম আদর্শের পরিপন্থী বলে অনেকে মনে করেন। ১৮৬৬ সালে ব্রাহ্ম সমাজের বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ হয়। ব্রাহ্ম সমাজ থেকে বার হ'য়ে কেশবচন্দ্র সেন ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। দেবেন্দ্রনাথ ও তাঁর অনুগামীরা আদি ব্রাহ্ম সমাজ নাম ধারণ করেন। মানবতাবোধের পূজারী ও ধর্মীয় ঐক্যের প্রবক্তা কেশবচন্দ্রের জীবদ্দশাতেই ব্রাহ্ম সমাজে আবার ভাঙ্গন ধরে। ১৮৭১-৭২ সাল থেকে কেশবচন্দ্রের কয়েকজন গুণমুগ্ধ ভক্ত ব্রাহ্ম সমাজে ব্যক্তিপূজার বিরুদ্ধে ও একটি সুস্পষ্ট সংগঠন গড়ে তোলার দাবীতে আন্দোলন শুরু করেন। কেশবচন্দ্রের সমাজ সংস্কার নীতিও তাদের দৃষ্টিতে যথেষ্ট প্রগতিশীল বলে মনে হয় নি। ১৮৭৪ সালে আনন্দমোহন বসু, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী, নগেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জী, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রভৃতি কয়েকজন চরম মতাদর্শে বিশ্বাসী। যুবক সমদর্শী দল গঠন করে কেশবচন্দ্রের বিরোধিতা শুরু করেন। এঁরা স্ত্রী-শিক্ষা ও স্বাধীনতা সম্পর্কে কেশবচন্দ্রের নরমপন্থী মনোভাব সমর্থন করলেন না। কেশবচন্দ্র মনে করতেন মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার প্রয়োজন নেই। নরনারীর অবাধ মেলামেশা ও পর্দাপ্রথার উচ্ছেদও তিনি পছন্দ করতেন না। বিদ্রোহী এই তরুণদের কিছুটা খুসী করার জন্য কেশবচন্দ্র ব্রাহ্ম সমাজকে আরও প্রতিনিধিমূলক করে তুলতে কিছু সাংবিধানিক সংস্কারের ব্রতী হন। কিন্তু একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাকে কেন্দ্র করে কেশবচন্দ্রের সঙ্গে তাঁদের বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে পড়ে। দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি হলো কেশবচন্দ্রের নাবালিকা কন্যার সঙ্গে কুচবিহারের রাজকুমারের বিবাহ। এই বিবাহ ১৮৭২ সালের Native Marriage Act এর পরিপন্থী ছিল। তাছাড়া হিন্দুমতে ব্রাহ্মণ পুরোহিতের পৌরোহিত্যে এই বিবাহ অনুষ্ঠিত হ'য়েছিল এবং ব্রাহ্ম সমাজের রীতি অনুসারে বিবাহ অনুষ্ঠানে ব্রাহ্ম প্রার্থনা সঙ্গীত গাওয়া হয় নি। কেশবচন্দ্রের মত শীর্ষস্থানীয় নেতার ব্রাহ্ম সমাজ বিরোধী এই ধরনের কার্যকলাপ কঠোরভাবে সমালোচিত হয়। ১৮৭৮ সালের ১৫ই মে প্রতিষ্ঠিত হলো সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ। প্রবীণ ব্রাহ্ম নেতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ও রাজনারায়ণ বসু সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের নেতাদের আশীর্বাদ জানান। সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের সংগঠন ছিল অনেক বেশী গণতান্ত্রিক। ব্রাহ্ম সমাজের এই ভাঙনের ফলে কেশবচন্দ্র কিছুটা বিমর্ষ ও নিঃসঙ্গ হ'য়ে পড়েন। এই সময় একদিকে তিনি রামকৃষ্ণের প্রভাবে হিন্দুধর্মের বহু দেবদেবীর আরাধনার মাধ্যমে এক ঈশ্বরের আরাধনার আদর্শ ও অন্যদিকে লুক রিভিংটনের প্রভাবে খৃষ্টান ধর্মের চিন্তাধারার দ্বারা প্রভাবিত হন। অবশেষে ১৮৮০ সালে তিনি তাঁর বিখ্যাত "নববিধান" প্রচার করেন। এর মাধ্যমে তিনি সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শ তুলে ধরেন। শুধু ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের মিলনই নয়, মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের বাণী তাঁর নব বিধানের মধ্যে উচ্চারিত হ'য়েছে। নব বিধানের আদর্শ প্রচার করার চার বছর বাদে কেশবচন্দ্রের মৃত্যু হয়।
রামমোহন ও দেবেন্দ্রনাথের পর কেশবচন্দ্রই ব্রাহ্ম আন্দোলনের ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রাখেন। যদিও তাঁর সময়েই ব্রাহ্ম সমাজে দু-বার ভাঙন ধরেছিল এবং বার বার এই ভাঙনের ফলে এই আন্দোলন কিছুটা গতিহীন ও লক্ষ্যভ্রষ্ট হ'য়েছিল, তবুও কেশবচন্দ্রের ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতেই বাংলা সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। কেশবচন্দ্র ছিলেন একজন দক্ষ বক্তা। তিনি ১৮৬৪ সালে বোম্বাই ও মাদ্রাজ এবং ১৮৬৮ সালে উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ সফর করেন। তাঁরই অনুপ্রেরণায় বোম্বাই শহরে ১৮৬৭ সালে প্রার্থনা সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৬৬ সালের জানুয়ারী মাসে প্রকাশিত Indian Mirror পত্রিকা থেকে জানা যায় যে ঐ সময় সারা ভারতে ব্রাহ্ম সমাজের মোট ৫৪টি শাখা প্রতিষ্ঠিত ছিল। এর মধ্যে ৫০টি ছিল বাংলায়, ২টি উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে এবং পাঞ্জাব ও মাদ্রাজে ১টি করে। এইভাবে ব্রাহ্ম আন্দোলন সর্বভারতীয় চরিত্র পায়। বার বার ভাঙনের ফলে সামগ্রিক ভাবে ব্রাহ্ম আন্দোলন দুর্বল হ'য়ে গিয়েছিল। তাছাড়া কেশবচন্দ্রের সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শ ও হিন্দুধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা এবং অন্যদিকে নবাহিন্দু আন্দোলনের ফলে হিন্দু ধর্মের পুনরুজ্জীবন উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যবধান যথেষ্ট কমিয়ে দিয়েছিল। অধ্যাপক দিলীপ কুমার বিশ্বাসের ভাষায় "The story of Brahmoism, in its last phase, is the story of its progressive absorption within the older religion from which it had sprung." -৩১ অন্যদিকে ব্রাহ্ম সমাজের আবেদন সমাজের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণ অশিক্ষিত মানুষ এর দ্বারা প্রভাবিত হয় নি। ব্রাহ্ম সমাজভুক্ত মানুষের চাল চলন, আচার ব্যবহার, শিক্ষা দীক্ষা ও সাহেবী আদব কায়দা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তাদের দূরে সরিয়ে রেখেছিল। তবু ঊনিশ শতকের বাংলা তথা ভারতের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে ব্রাহ্ম সমাজের প্রভাব ও অবদান অনস্বীকার্য। ব্রাহ্ম সমাজ যে সব প্রগতিশীল সমাজ ও ধর্ম সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছিল, তার যৌক্তিকতা সম্পর্কে বিতর্কের কোন অবকাশ নেই। শিক্ষিত হিন্দুরাও এইসব সংস্কারের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। ব্রাহ্ম আন্দোলনের ফলেই ভারতের অচল অনড় সমাজে প্রগতিশীলতার হাওয়া বইতে থাকে। শিক্ষা বিস্তারে, বিশেষতঃ স্ত্রী শিক্ষা প্রসারে ব্রাহ্ম সমাজের ভূমিকা সত্যই প্রশংসনীয়। কলকাতার ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশন ও সিটি কলেজ ব্রাহ্মরাই প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য নাহ'লেও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সিটি কলেজে পড়াতেন। ছাত্রদের সার্বিক উন্নতির জন্য ব্রাহ্ম সমাজ Students' Weekly Service এর উদ্যোগে ধর্মীয়, নৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে বিভিন্ন আলোচনা চক্রের ব্যবস্থা করতো। প্রগতিশীল ও শিক্ষিত মহিলারাও যাতে নিজেদের মধ্যে ভাবের আদান প্রদান করতে পারে এবং নানা বিষয়ে প্রবন্ধ পাঠ করতে পারে, তার জন্য একটি সমাজ স্থাপন করা হয়েছিল। একটি পাঠাগার ও ছাপাখানা খোলা হয়। এই ছাপাখানায় “তত্ত্বকৌমুদী” নামে একটি বাংলা পত্রিকা এবং Brahmo Public Opinion নামে একটি ইংরেজী পত্রিকা ছাপা হতো। ১৮৮৪ সালে কৃষ্ণকুমার মিত্রের সম্পাদনায় সঞ্জীবনী নামে একটি বিখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সমাজ সংগঠনমূলক পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়। দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে ব্রাহ্ম সমাজের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ না থাকলেও ব্রাহ্ম নেতারা সাধারণ মানুষের কথা পুরোপুরি ভুলে যাননি। ভারতের শ্রমজীবী মানুষের সুখ দুঃখের কথা ব্রাহ্মরাই সম্ভবতঃ প্রথম জোরালো ভাষায় তুলে ধরেছিল। বরানগরের ব্রাহ্ম নেতা শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায় “ভারত শ্রমজীবী” নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে শ্রমিকদের মধ্যে চেতনার সঞ্চার করেন। তিনি তাদের শিক্ষার জন্য একটি নৈশ বিদ্যালয় খোলেন। আর একজন ব্রাহ্ম নেতা দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী আসামের চা বাগানের কুলিদের সংগঠিত করতে সচেষ্ট হন। রাম কুমার বিদ্যারত্ন 'কুলি কাহিনী' নামে একটি বই লিখে চা বাগানের শ্রমিকদের উপর অকথ্য অত্যাচার ও নির্যাতনের মর্মস্পর্শী বিবরণ দেন। শিবনাথ শাস্ত্রীও শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলার কথা বলেছিলেন। বিভিন্ন অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ কবলিত মানুষকে সাহায্য করার কাজেও ব্রাহ্ম নেতারা এগিয়ে এসেছিলেন। ব্রাহ্ম সমাজের নেতারা ভারতের জনগণকে জাতীয়তাবোধের আদর্শেও উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। কেশবচন্দ্র পশ্চিমী সভ্যতা ও আদর্শের যা কিছু ভাল তা গ্রহণ করতে প্রস্তুত থাকলেও ভারতীয় কৃষ্টি ও ঐতিহ্য বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে কেশবচন্দ্রের যথেষ্ট গর্ব ছিল। ব্রিটিশ সরকারের তিনি অন্ধ সমর্থক ছিলেন না, বরং প্রয়োজনে কঠোর সমালোচক ছিলেন। England's Duties in India স্মারক বক্তৃতায় তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের তীব্র সমালোচনা করে বলেন— "You cannot hold India for the interest of Mancester ১৩২ ঐ ভাষণে তিনি সরকারী প্রশাসনে উচ্চপদে ভারতীয়দের নিয়োগ করার জন্য জোরালো বক্তব্য রেখেছিলেন। কেশবচন্দ্রের এই ভাষণ ইংল্যাণ্ডে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। বাঙালী যুবকদের মধ্যে মদ্যপানের কুফলের জন্যও তিনি ইংরেজদের দায়ী করেছিলেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন—“Is not this liquor traffic carried on in India simply, solely and exclusively for the sake of revenue?" তিনি বলেছিলেন যে ইংরেজরা যদি ভালভাবে দেশকে শাসন করতে না পারে, তাহলে তাদের ভারত ছেড়ে চলে যেতে হবে। ব্রাহ্ম নেতারা ব্যক্তি স্বাধীনতা ও চিন্তার উপর গুরুত্ব আরোপ করে এবং যুক্তিবাদের মন্ত্রে শিক্ষিত যুব সমাজকে দীক্ষিত করে ভারতের ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে এক নব জাগরণ ঘটিয়েছিলেন। এ কথা সত্য যে, ব্রাহ্ম আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েনি এবং হিন্দু ধর্ম ও সমাজে কোন বড় ধরনের ভাঙন ধরাতে পারে নি। তবু তাদের সমাজ সংস্কার হিন্দুরাও পরে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। হিন্দুরা অবশ্য পৌত্তলিকতা ছাড়তে পারে নি। ব্রাহ্ম আন্দোলন এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হ’য়েছিল। ব্রাহ্ম আন্দোলনের প্রভাব আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে গেলেও ব্রাহ্ম সমাজ বহু মহাপুরুষের জন্ম দিয়েছিল, যাঁদের অবদান আমরা আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। এইসব মহাপুরুষের মধ্যে জগদীশ চন্দ্র বসু, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, অরবিন্দ ঘোষ, বিপিন চন্দ্র পাল, চিত্তরঞ্জন দাশ, রামতনু লাহিড়ী, সরোজিনী নাইডু, সরলা দেবী চৌধুরাণী এবং অবশ্যই ঠাকুর পরিবারের সদস্যদের নাম মনে পড়ে। ব্রাহ্ম সমাজের একটি বড় অবদান হলো কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে এই আন্দোলন একটি সর্বভারতীয় আন্দোলনের রূপ নিয়েছিল। এই দিক দিয়ে তাঁকে সুরেন্দ্রনাথের পূর্বসূরী বলা যায়। ব্রাহ্ম সমাজের প্রভাবে মহারাষ্ট্রে প্রার্থনা সমাজের প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। একথা অবশ্য সত্য যে, বাংলার বাহিরে ব্রাহ্ম সমাজের শাখা প্রতিষ্ঠিত হলেও তার মূল গভীরে প্রবেশ করতে পারে নি। তবু ব্রাহ্মরা ভারতীয় জনগণের মধ্যে বিশেষতঃ শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে, যে চেতনার সৃষ্টি করেছিল, তার গুরুত্ব স্বীকার করতেই হবে। আজও তার প্রাসঙ্গিকতা ফুরিয়ে যায় নি। নববিধানের আদর্শ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেশবচন্দ্র বলেছিলেন "Jesus, Moses, Sri Chaitanya, Nanak, Kabir, Sakya Muni, Muhammad etc. have come with their disciples to welcome the child... It is no ordinary child. After its birth, there cannot be two sects, two dispensations. All religions have now become one. All dispensations have now been merged into one." কেশবচন্দ্রের এই বর্ণনার মধ্যে যে মানবতাবোধ ও সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শ উচ্চারিত হ'য়েছে ও ঈশ্বরের স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে, তার আবেদন শাশ্বত। দেবেন্দ্রনাথ তাকে ব্রহ্মানন্দ বলে সম্ভাষণ করে অতিশয়োক্তি করেন নি।
0 Comments
If you like the posts, you must comment. and if there is any problem , please let me know in the comments.