নীল বিদ্রোহ নিয়ে আলোচনা কর ।|নীল বিদ্রোহ কি ? নীল বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর ? | নীল বিদ্রোহের প্রকৃতি আলোচনা কর । | প্রবন্ধ লেখ নীল বিদ্রোহ |নীল চাষ, নীল বিদ্রোহ, নীলদর্পণ নাটক ও রেভারেন্ট জেমস্ লঙ |নীল বিদ্রোহী খ্রিস্টান মিশনারিদের ভূমিকা |What is indigo Rebellion? Discuss the causes and results of the indigo Rebellion?|Indigo revolt in Bengal (1859-61)| What was blue rebellion |Best quality note Indigo revolt. |
নীল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য প্রথমতঃ
নীল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য দ্বিতীয়তঃ
গান্ধীর অনেক আগেই যেন তারা ঘোষণা করেছিল। - 'করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে'। শেষ পর্যন্ত তারা বাংলা থেকে নীলচাষের উচ্ছেদ করে তবে ছেড়েছিল। অর্থাৎ তাদের আন্দোলন ছিল সার্থক ও সফল। অনেকে মনে করেন কৃত্রিম নীলের আবিষ্কারের ফলেই নীল চাষ বন্ধ হয়ে যায় এবং এর সঙ্গে নীল বিদ্রোহের কোন সম্পর্ক নেই। এভাবে নীল বিদ্রোহের গুরুত্বকে ছোট করার কোন অর্থ হয় না। অধ্যাপক বিনয়ভূষণ চৌধুরী বলেছেন যে, ১৮৮০-র দশকের আগে কৃত্রিম নীলের কোন প্রভাব অনুভূত হয়নি। তবে ভারত থেকে নীল চাষ উঠে যায় নি। কিন্তু বাংলার কৃষকদের অনমনীয় মনোভাব নীলকরদের বাধ্য করেছিল বিহারে নীলচাষ সরিয়ে নিয়ে যেতে। কিছু নীলকুঠীর সাহেব নীল থেকে মূলধন সরিয়ে নিয়ে চা-বাগানে তা বিনিয়োগ করতে বাধ্য হয়। যাই হোক এই ধরনের সফল আন্দোলনের উদাহরণ বেশি নেই।
নীল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য তৃতীয়তঃ
অন্যান্য কৃষক বিদ্রোহের ক্ষেত্রে সরকার যে ধরনের কৃষক বিরোধী মনোভাব গ্রহণ করেছিল ও বিদ্রোহ দমন করতে তৎপর ও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিল, এ ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটেছিল। বরং সরকারের নীলকর বিরোধী মনোভাব কৃষকদের বিদ্রোহ করতে যথেষ্ট অনুপ্রাণিত করেছিল। অনেক আগে থেকেই সরকার নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা চিন্তা করেছিল। ১৮১০ সালের ১৩ই জুলাই স্বয়ং গভর্নর জেনারেল এই মর্মে এক বিবৃতি দিয়েছিলেন। এই ঘোষণায় অবশ্য কোন ফল হয়নি। ১৮৫৪ সালে যশোহরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ম্যাকেঞ্জি নামে জনৈক নীলকর সাহেবকে প্রজাদের দিয়ে জোর করে নীল চাষ করাতে নিষেধ করেছিলেন। ১৮৫৫ সালে নদীয়ার ম্যাজিস্ট্রেটও একই ভাবে নির্দেশ জারি করায় বহু প্রজা নীল চাষ থেকে বিরত থাকে। এরপর বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেট এড়েন একটি পরোয়ানা জারী করে বলেন যে, চাষীরা তাদের জমিতে কি চাষ করবে তা তাদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার। সরকারের এই ধরনের মনোভাব নিঃসন্দেহে তাদের উৎসাহিত করেছিল।
নীল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য চতুর্থতঃ
এল. নটরাজনের মতে নীলের চাষ করতে অস্বীকৃত হ'য়ে বাংলার কৃষকেরা ভারতের ইতিহাসে প্রথম হরতাল বা ধর্মঘটের নজির সৃষ্টি করে। তাঁর প্রবন্ধটির নাম রাখা হয়েছে Indigo Cultivators' Strike 1960। তাঁর মতে মহাত্মা গান্ধীর অনেক আগেই বাংলার কৃষকেরা হরতালের অস্ত্র প্রয়োগ করেছিল। তাঁর উদ্ধৃতি দিয়ে বলি – “Even before the start of the Indian working class movement, even before the birth of Mahatma Gandhi, the peasants.....had taken to the path of general strike " ভারতের কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে তিনি এই ঘটনাকে অভিনব বলে উল্লেখ করেছেন।
নীল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য পঞ্চমতঃ
নীল বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের মানুষ যোগ দিয়েছিল। শুধু কৃষকরাই নয়, এই বিদ্রোহে সামিল হয়েছিল কিছু জমিদার, ব্যবসায়ী, তালুকদার, পত্তনিদার। এটা ঠিক যে, কৃষকদের স্বার্থ আর এদের স্বার্থ এক ছিল না। ভূস্বামী শ্রেণী নিজেদের স্বার্থে এই বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল। ব্লেয়ার ক্লিং মন্তব্য করেছেন যে, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় নীলকরদের সঙ্গে ব্যবসা করে প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় প্রজা বিদ্রোহের সুযোগ নিয়েছিল। ৪৫ যাই হোক নীল বিদ্রোহের সময় বিদ্রোহীদের মধ্যে যে ঐক্য দেখা গিয়েছিল, তা অবশ্যই উচ্চ প্রশংসার দাবী রাখে। এ প্রসঙ্গে নীলকর হার্সেলের মন্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি কলকাতার এক এজেন্টকে লিখেছিলেন “আমার বিশ্বাস এমনতরো ঐক্য ও সংহতি বাংলার কৃষক সমাজ ইতিপূর্বে কখনো প্রদর্শন করে নি। বাঙালীর অনৈক্য সম্পর্কে বাঙালীদেরমধ্যেই অনেক রকম প্রবাদ প্রবচন প্রচলিত আছে। আমি নিজের কানে এদের বহুবার বলতে শুনেছি যে, বাঙালীদের মধ্যে ঐক্যের বড় অভাব, কিন্তু এখন কোন ইউরোপীয়ের বিরুদ্ধে এক গ্রামের রায়তরা মামলা রুজু করলে বা কোন দাঙ্গা শুরু করলে অন্য গ্রামের লোকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের প্রতি সংহতি ঘোষণা করে এবং সংগ্রাম তহবিলে চাদা দেয়। এই ধরনের সার্বিক ঐক্য আগে দেখা যায় নি। অন্যদিকে এই বিদ্রোহ ছিল সম্পূর্ণরূপে ধর্ম নিরপেক্ষ। এর পূর্ববর্তী ওহাবী, ফরাজী ও সাঁওতাল বিদ্রোহে ধর্মের যে ব্যাপক প্রভাব ও প্রেরণা একটি প্রধান চালিকা শক্তি হিসাবে কার্যকরী ছিল, এ ক্ষেত্রে তার অভাব স্পষ্টই আমাদের চোখে পড়ে। এ বিদ্রোহ ছিল মূলতঃ কৃষকদের অধিকার রক্ষার বিদ্রোহ। এর সঙ্গে ধর্মের কোন যোগ ছিল না।
নীল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য ষষ্ঠতঃ
নীলবিদ্রোহে খৃষ্টান মিশনারীরা বিদ্রোহীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। তারা নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল এবং এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। এই সব খৃষ্টান মিশনারীদের মধ্যে ইংল্যাণ্ডের চার্চ মিশনারী সোসাইটির তিন জন জার্মান মিশনারী খ্রিষ্টিয়ান বনভাইটস্, ফ্রেডারিক সুর এবং জে. জি.লিংকে-এর নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এঁদের কর্মক্ষেত্র ছিল নদীয়া। এদের মধ্যে বমভাইটস্ ছিলেন সবচেয়ে সক্রিয়। নীলকরদের অত্যাচার সম্পর্কে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল। তিনি নীলকরদের অত্যাচার সম্পর্কে হিন্দু পেট্রিয়ট ও ইণ্ডিয়ান ফিল্ডে প্রায়ই চিঠি লিখতেন। বলা বাহুল্য নীলকর সাহেবরা তাঁর উপর আদৌ প্রীত ছিল না। এবং তাঁর বিরুদ্ধে নানা ভাবে বিষোদ্গার করতো। নীল বিদ্রোহে জেমস্ লং-এর ভূমিকা সর্বজনবিদিত। তিনি সমকালীন বাংলা পত্র পত্রিকার নিয়মিত পাঠক ছিলেন এবং তা থেকে তিনি নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কথা জানতে পারেন। ইণ্ডিগো কমিশনের কাছে খৃষ্টান পাদ্রীরা নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কথা তুলে ধরেছিল। ইন্ডিগো কমিশনও নীল বিদ্রোহে পাদ্রীদের ভূমিকার কথা স্বীকার করে বলেছিল যে, তারা কোন ব্যক্তিস্বার্থে বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই আন্দোলনে যোগ দেয় নি। সম্প্রতি ডঃ অভিজিৎ দত্ত এর একটা ভিন্নতর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য হলো আসলে খৃষ্টান মিশনারীরা ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের হিতৈষী। তাঁরা চেয়েছিলেন ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ স্থায়ী হোক। সেই জন্য তাঁরা দেশীয় মানুষের মধ্যে ধূমায়িত ক্ষোভ ও অসন্তোষ সম্পর্কে সরকারকে সচেতন ও সতর্ক করতে চেয়েছিলেন। তিনি অবশ্য তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে কোন তথ্য প্রমাণ দেন নি। তবে পাদ্রীরা নীল বিদ্রোহ সমর্থন করলেও নীল ব্যবসার অবসান চাননি। এ প্রসঙ্গে ডঃ অভিজিৎ দত্তের বক্তব্য হলো "The missionaries were not against the planters, personally, nor against the indigo industry in Bengal, but only against the rampant monstrosities of the indigo system. This is revealed by their negative stand on the question of the termination of the indigo industry in rural Bengal." এই ধরনের সীমাবদ্ধতা স্বত্ত্বেও মিশনারীরা যেভাবে নীল বিদ্রোহের সঙ্গে নিজেদের আন্তরিকভাবে জড়িয়ে ফেলেছিল, তারা আর কখনও তা করেনি।
সবশেষে নীল বিদ্রোহ সেই সময়ে বাঙালী সমাজে যে চাঞ্চল্য ও আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল, তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাঙালী মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় সাধারণভাবে কৃষকদের দুঃখ দুর্দশা নিয়ে খুব একটা ভাবনা চিন্তা না করলেও নীলচাষীদের সম্পর্কে তাদের সহানুভূতি ছিল। ১৮১৯ সালে অক্ষয়কুমার দত্ত 'তত্ত্ববোধিনী' পত্রিকায় এবং ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত 'প্রভাকর' পত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি করেছিলেন। কিন্তু নীল বিদ্রোহের সঙ্গে সঙ্গেই বাঙালী মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় বিদ্রোহীদের পক্ষ নিয়ে হাজির হয়। এই প্রসঙ্গে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও তাঁর সম্পাদিত হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকার কথা সহজেই মনে পড়ে তিনি যেভাবে এই বিদ্রোহে রায়তদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, তা আমাদের প্রশংসা কেড়ে নেয় এবং অনেকেই সঙ্গত কারণে এর জন্য তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। শিবনাথ শাস্ত্রী বলেছেন। “নীলকর অত্যাচার নিবারণ হরিশের এক অক্ষয় কীর্তি। এই কার্যে তিনি দেহ, মন, অর্থ, সামর্থ সকলি এই একক নিয়োগ করিয়াছিলেন।” হরিশচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে সুপ্রকাশ রায় মন্তব্য করেছেন “হরিশচন্দ্র একাকী বাংলার জনসাধারণের—কৃষকের জাতীয় সংগ্রামে নিজেকে নিঃশেষে দান করিয়া যেন সমগ্র মধ্যশ্রেণীর দূরপনের কলঙ্ক স্খলনের চেষ্টা করিয়া গিয়াছেন এবং এইভাবে মহান জাতীয় কর্তব্য সাধনে আত্মদান করিয়া ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যশ্রেণীর ভিতর অতুলনীয় হইয়া রহিয়াছেন।” যোগেশচন্দ্র বাগলের বক্তব্য হলো “ইংরেজদের স্বেচ্ছাচারের কথা হিন্দু পেট্রিয়টে যেরূপ নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হইতে লাগিল এমন কি তখনকার কোন পত্রিকায়ই বাহির হইত কিনা সন্দেহ। যশোহরের শিশিরকুমার ঘোষ, কৃষ্ণনগরের মনোমোহন ঘোষ, কুমারখালির হরিনাথ মজুমদার ও মথুরানাথ মৈত্রেয়, দীনবন্ধু মিত্র প্রভৃতির দ্বারা প্রেরিত নীলকরদের অত্যাচারের কথা হরিশচন্দ্র যথারীতি পেট্রিয়টে প্রকাশ করিতেন এবং তাহার উপর টিপ্পনী ও মন্তব্য লিখিতেন।” এ ধরনের উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই। যাদের জন্য তিনি জীবন পণ ও সব কিছু ত্যাগ করেছিলেন, সেই রায়তরা হরিশের অকাল মৃত্যুতে (অমানুষিক পরিশ্রমে স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যাওয়ায় হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় মাত্র বছর বয়সে মারা যান) কতখানি শোকাহত হয়েছিল, শুধু তাদের প্রাণের কথা বলেই এ প্রসঙ্গে ইতি টানি- " নীল বাঁদরে সোনার বাঙলা করল এবার ছারখার,অসময়ে হরিশ মল, লঙের হলো কারাগার।”
হরিশচন্দ্র তাঁর পত্রিকায় নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিবরণ তুলে ধরে তাদের বিরাগভাজন হ'য়েছিলেন এবং এর জন্য তাঁকে অনেক গালাগালি সহ্য করতে হ'য়েছিল। তাঁকে নিগার বলে সম্বোধন করে যে চিঠি লেখা হয়েছিল, তা তিনি হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকায় ছাপিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু শুধু লেখালেখি করেই তিনি তাঁর কর্তব্য শেষ করেননি; তিনি কৃষকদের নানা পরামর্শ দিয়েও সাহায্য করতেন। তারা তাঁকে আপনজন বলে মনে করতো এবং তাদের জন্য তাঁর দরজা সব সময়েই খোলা থাকতো। কৃষকদের সাহায্য করতে গিয়ে তিনি ঋণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং এর জন্য তাঁর পরিবারকে বহু দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল। তাঁকে সাহায্য করার জন্য উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় একটি তহবিল খুলেছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু নীল বিদ্রোহে শুধু হরিশচন্দ্রই আত্মনিয়োগ করেন নি। অমৃতবাজার পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা শিশির কুমার ঘোষও এই বিদ্রোহে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি শুধু সাংবাদিকের দায়িত্বই পালন করেননি। তিনি যশোহর নদীয়ার গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষকদের সঙ্ঘবদ্ধ করেন। অন্যদিকে দীনবন্ধু মিত্র “নীলদর্পণ” নাটক লিখে কিভাবে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিলেন এবং এই নাটকের ইংরাজী অনুবাদ জেমস্ লং-এর নামে প্রকাশিত হ'য়ে যে সব নাটকীয় ঘটনা ঘটেছিল, তাও প্রত্যেক বাঙালীর জানা। কিন্তু সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচতাও যে নীলকর দমনে একটি বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন, তা আমরা প্রমোদরঞ্জন সেনগুপ্ত বিরচিত' নীল বিদ্রোহ ও বাঙালী সমাজ' গ্রন্থ থেকে জানতে পারি। খুলনা-যশোহরের জমিদার নীলকর মরেলকে তিনি শায়েস্তা করেছিলেন। প্রসঙ্গতঃ একটা কথা মনে রাখা দরকার; তা হলো বাঙালী মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সম্প্রদায়ের একটা ভগ্নাংশ মাত্র নীল বিদ্রোহে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। এজন্য শিশির কুমার ঘোষ তাদের ধিকার দিয়েছিলেন। হরিশচন্দ্র যখন নীল বিদ্রোহের ফলে এক প্রকার সর্বস্বান্ত হন, তখন তাঁকে সাহায্য করতে খুব বেশী মানুষ এগিয়ে আসেন নি। তবু নীল বিদ্রোহ বাঙালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যতটা সহানুভূতি আকর্ষণ করেছিল, অন্যান্য কৃষক বিদ্রোহ তা করতে পারে নি। হিন্দু পেট্রিয়ট ছাড়া অন্য পত্র পত্রিকাও নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিল।
এবার আসা যাক নীল বিদ্রোহ কেন হ'য়েছিল সেই প্রসঙ্গে। তবে মনে রাখা দরকার যে ১৮৬০ সালের আগেও নীলকরদের বিরুদ্ধে বার বার আন্দোলন হয়েছে। ঊনিশ শতকের গোড়াতেই নদীয়া জেলার চৌগাছা গ্রামের অধিবাসী বিশ্বনাথ সর্দার বা বিশে ডাকাত নীলচাষের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। বিশ্বনাথ সর্দারের জীবনীকার শ্রীহারাধন দত্ত তাঁকে “বাংলাদেশে নীল আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ও পথিকৃৎ” বলে অভিহিত করেছেন। বিশ্বনাথ নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। ও ফাঁসিতে মৃত্যুবরণ করে নীল আন্দোলনের প্রথম শহীদ হন। তাঁর কার্যকলাপ নদীয়া জেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং তাঁর কর্মপদ্ধতি ছিল নীলকুঠী লুণ্ঠন। ১৮৩১- ৩২ সালে বারাসাতের তিতুমীর বিদ্রোহ ও ১৮৪৬ সালের ফরিদপুরে ফরাজী বিদ্রোহেও নীলকরদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিল। ১৮৫৪ সালে যশোহরের কৃষকেরা নীলের চাষ করতে অস্বীকৃত হয়। এই ভাবে নানা স্থানে বিভিন্ন সময়ে নীল বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছিল। এইসব আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল জোরজবস্তি নীলচাষ বন্ধ করা। কিন্তু ১৮৫৯-৬২ সালের নীলবিদ্রোহ হয়েছিল ব্যাপক এলাকা জুড়ে এবং এর ব্যাপ্তি ছিল অনেক বেশি। এই বিদ্রোহের লক্ষ্য ছিল নীল চাষেরই পুরোপুরি বিলোপ
নীল বিদ্রোহের প্রধান কারণ গুলি হলো:
নীল বিদ্রোহের প্রধান কারণ অবশ্যই কৃষকদের মধ্যে গভীর ক্ষোভ ও অসন্তোষ। এই ক্ষোভ ও অসন্তোষের জন্ম হয়েছিল দুটি কারণে প্রথমতঃ নীল চাষ চাষীদের পক্ষে মোটেই লাভজনক ছিল না; এবং দ্বিতীয়তঃ জোরজবস্তি করে কৃষকদের নীলচাষ করতে বাধ্য করা হতো। কিভাবে এই ক্ষোভ ও অসন্তোষ বাংলার কৃষকদের বিদ্রোহের দিকে ঠেলে দেয়, তা বুঝতে হ'লে নীল চাষ সম্পর্কে দু-একটি কথা বলে নেয়া দরকার। তখনও কৃত্রিম নীল আবিষ্কার হয় নি। ফলে কাপড় রঙ করার জন্য ভারতীয় নীলের যথেষ্ট চাহিদা ছিল। অষ্টাদশ শতকের শেষে এবং ঊনিশ শতকের প্রথমে ইংল্যাণ্ডে শিল্প বিপ্লব ঘটে এবং বস্তু বয়ন শিল্পে যুগান্তর আসে। এই অবস্থায় ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর পৃষ্ঠপোষকতায় বাণিজ্যিক ভাবে নীলের চাষ শুরু হয় অষ্টাদশ শতকের শেষে। ঊনিশ শতকের তৃতীয় দশকে বেন্টিঙ্কের সময়ে নীলকর সাহেবরা বাংলা ও বিহারে চুটিয়ে নীল চাষ করতে থাকে। এর জন্য পুঁজি যোগাতো কলকাতার এজেন্সি হাউসগুলি। নীল চাষকে প্রকৃত অর্থে বাগিচা পদ্ধতিতে (plantation system) চাষ বলা চলে না। আসাম ও শ্রীলঙ্কার চা বাগানে অথবা পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে চিনির খামারে যেভাবে ভাড়াটে শ্রমিকের সাহায্যে চাষবাস হতো, নীলের চাষ সেভাবে হতো না। বাংলা ও বিহারে ইউরোপীয় পুঁজি বিনিয়োগ করে নীলকুঠী স্থাপিত হতো। কিন্তু জমিদারের জমিতে জমিদারের প্রজারা অন্যান্য শস্যের সঙ্গে নীলেরও চাষ করতো। এইভাবে আফিং-এর চাষও হতো। কিন্তু আফিং চাষ ছিল সরকারের একচেটিয়া অধিকারে এবং বেসরকারী কোন সংস্থা এর চাষ করতে পারতো না। ফড়েদের মারফৎ সরকার তা কৃষকদের কাছ থেকে খরিদকরতেন। এ ক্ষেত্রে চাষীরা আফিং-এর চাষ করবে কি করবে না, তা তারা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারতো। বস্তুতঃ সরকার যখন আফিং-এর ক্রয়মূল্য হ্রাস করেন, কৃষকেরা তখন এই চাষ বন্ধ করে অপেক্ষাকৃত লাভজনক অন্য কোন ফসল উৎপাদন করতে থাকে। এই ধরনের সুবিধা নীল চাষে ছিল না বলে চাষীদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ জন্মায় এবং তা বিদ্রোহের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। অন্যদিকে আফিং “কে কেন্দ্র করে কোন বিদ্রোহ ঘটে নি। যাই হোক নীলকর সাহেবরা চাষীদের দাফন বা অগ্রিম দিয়ে নীল চাষ করাতো। এই অগ্রিম থেকে চাষীরা জমিদারের খাজনা মেটাতো ও অন্যান্য খরচ করতো। নীলকরদের শর্ত ছিল যে চাষীরা তাদের জমির একটা নির্দিষ্ট অংশে নীল চাষ করবে এবং উৎপন্ন ফসল নীলকরদের হাতে তুলে দেবে। প্রজারা এই ধরনের শর্ত মানতে না চাইলে নীলকর ও তাদের লোকজন কর্মচারী তাদের তা মানতে বাধ্য করতো। এমন কি জমিদারেরাও কখনও কখনও চাপ সৃষ্টি করতো। জমিদারের স্বার্থ ছিল এইখানে যে, এর ফলে তারা নিয়মিত কর প্রদান সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হতো। অনেক সময় জমিদার নিজেই নীলকরদের কাছে ঋণগ্রস্ত থাকতেন। তাই তারা নীলকরদের বিরুদ্ধে যেতে পারতেন না। ফলে তারাও অনেক সময় নীলকরদের পছন্দ করতেন না।
বাংলার কৃষকদের কাছে নীলকর সাহেবরা ছিল ত্রাসের নামান্তর। নীল চাষের অর্থ ছিল চাষীর সর্বনাশ। একবার দাদন নিয়ে নীলের চাষ করলে চাষীর মুক্তির কোন পথ খোলা থাকতো না। আসলে নীলের চাষ চাষীর ইচ্ছার উপর নির্ভর করতো না। তাকে নীলের চাষ এক প্রকার বাধ্য হ'য়ে করতে হতো। অষ্টাদশ শতকের শেষে নীলকর সাহেবরা কিভাবে রায়তদের জোরজবস্তি করে নীল চাষ। করতে বাধ্য করতো এবং কোম্পানীর সরকার তাদের অভাব অভিযোগের প্রতিকার করতে ব্যর্থ হ'য়েছিল, তা ডঃ নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহের গবেষণা থেকে আমরা জানতে পারি। ইন্ডিগো কমিশনের রিপোর্ট ও মিশনারীদের সাক্ষ্য থেকেও চাষীদের প্রতি নির্যাতনের তথ্য পাওয়া যায়। সমকালীন পত্র পত্রিকাতেও এর বহু নজীর আছে। শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন “নীলকরগণ জোর করিয়া উৎকৃষ্ট জমিতে নীল বুনাইয়া লইতেন । বলপূর্বক তাহাদিগের গো লাঙ্গলাদি ব্যবহার করিতেন, তাহাদিগের আদেশ অনুযায়ী কার্য করিতে না চাহিলে প্রহার, কয়েদ, গৃহদাহ প্রভৃতি নৃশংস অত্যাচার করিতেন এবং অনেক স্থলে জমিদার হইয়া বসিয়া অবাধ্য প্রজাদিগকে একেবারে ধনে প্রাণে সারা করিতেন। ” ১৮৫০ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় অক্ষয় কুমার দত্ত লিখলেন - “নীলকরদিগের কার্যের বিবরণ করিতে হইলে প্রজাপীড়নের বিবরণ লিখিতে হয়। নীল প্রস্তুত করা প্রজাদিগের মানস নহে। নীলকর তাহাদিগকে বল দ্বারা তদ্বিষয়ে প্রবৃত্ত করেন ও নীলবীজ বপনার্থে তাহাদিগের উত্তমোত্তম ভূমি নির্দিষ্ট করিয়া দেন। প্রজারা যে ভূমিতে ধান্য ও অন্যান্য শস্য বপন করিলে অনায়াসে সম্বৎসর পরিবার প্রতিপালন করিয়া কাল যাপন করিতে পারে, তাহাতে নীলকর সাহেবের নীল বপন করিলে তার লাভ দূরে থাকুক, তাহাদিগের দুশ্ছেদ্য ঋণজালে বদ্ধ হইতে হয়। অতএব তাহারা কোনক্রমেই স্বেচ্ছানুসারে এ বিষয়ে প্রবৃত্ত হয় না। সম্ভবতঃ সবচেয়ে মর্মস্পর্শী বিবরণ দিয়েছিলেন ফরিদপুরের ম্যাজিস্ট্রেট দেলাতুর। তাঁর কথায় বলি "এমন একটা বাক্স নীল ইংল্যাণ্ডে পৌঁছায় না যেটা মানুষের রক্তে রঞ্জিত নয়। এই উক্তির জন্য মিশনারীদের দোষ দেয়া হয়েছে। এ উক্তি আমারও উক্তি। ফরিদপুর জেলার ম্যাজিষ্ট্রেট থাকাকালীন আমি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তা থেকে আমিজোর দিয়ে বলতে চাই যে, কথাটা সম্পূর্ণভাবে সত্য।”২৮ প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে নীলকর সাহেবরা কেবল অত্যাচার বা উৎপীড়নই করতো না; তারা যেভাবে কৃষকদের সঙ্গে অভদ্র আচরণ করতো মিশনারীদের সাক্ষ্য থেকে আমরা তাও জানতে পারি। তারা অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতো। রেভারেও রথবার্ট তাঁর ভাষ্যে বলেছেন • "The very names, Niggers, Blackeys, etc., by which the natives are commonly designated, are names of contempt, and mark the estimation in which they are almost universsally held." এই ধরনের আচরণ প্রজা অসন্তোষে ইন্ধন যুগিয়েছিল। অন্যদিকে নীলকর সাহেবের সঙ্গে সঙ্গে নীলকুঠীর দেশীয় কর্মচারীরাও রায়তদের উপর অত্যাচার করতো। তারা অনেক সময় নানা অজুহাতে রায়তদের কাছ থেকে টাকা আদায় করতো এবং নানাভাবে তাদের হয়রানি করতো। রেভারেও রামহার্ড (Blumhardt) ইণ্ডিগো কমিশনের সামনে তাঁর সাক্ষ্যে বলেন যে "I have often been told by the ryots that they do not so much blame the sahab himself, as the servants connected with the concern." সবচেয়ে দুর্ভাগ্য ও পরিতাপের বিষয় এই যে, নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার কোন পথই হতভাগ্য কৃষকদের সামনে খোলা ছিল না। আইন আদালত, সরকারী কর্মচারী, পুলিশ সবই ছিল নীলকরদের পক্ষে। সুতরাং এক প্রকার অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া রায়তদের সামনে আর কোন পথ খোলা ছিল না।
দীর্ঘদিন ধরেই রায়তরা নীলকরদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট হলেও এবং মাঝে মাঝে তারা প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তুললেও ১৮৫১–৬২ সালের ব্যাপক আন্দোলনের পিছনে আরও কয়েকটি আনুসঙ্গিক কারণ ছিল। বস্তুতঃ ১৮৪৭ থেকে ১৮৫৯ সালের মধ্যে পর পর কিছু ঘটনা কৃষকদের মরিয়া করে তোলে। ১৮৪৭ সালে ইউনিয়ান ব্যাঙ্ক ফেল করায় নীলকরদের পুঁজিতে টান পড়ে, কারণ এই ব্যাঙ্কই ছিল নীলকরদের পুঁজির প্রধান উৎস। এই অবস্থায় তারা চাষীদের উপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে ১৮৪২ সালের পর থেকে নীলের বাজারে মন্দা দেখা দেয়। এর মন্দার কারণ হলো মাত্রাতিরিক্ত উৎপাদন বৃদ্ধি। নীলের বাজারমূল্য পড়ে যাওয়ায় বহু নীলকর দেউলিয়া হয়ে যায়। এই অবস্থায় সেই সব নীলকরই তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছিল, যারা কম দামে চাষীদের নীল চাষ করতে বাধা করেছিল। আবার একদিকে বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি ও অন্যদিকে নীলের চেয়ে বেশি লাভজনক বাণিজ্যিক পণ্যের (যেমন -পাট, তৈলবীজ ইত্যাদি) প্রচলন নীল অর্থনীতিতে এক গভীর সংকটের সূত্রপাত করে। কৃষকরা নীল চাষ করতে অস্বীকৃত হয়, কারণ নীল চাষে তখন কোন লাভ ছিল না। আগে বিঘা প্রতি জমিতে নীল চাষে খরচ হতো ২ থেকে ৩ টাকা। আয়ও হতো তাই। তবে লাভ ক্ষতি কিছুই না হলেও নীলচাষীরা অর্থের অভাবে এবং দাদনের লোভে নীল চাষ করতো। কিন্তু ১৮৫০ এর দশকের শেষ দিকে নীল চাষ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করলে তার আয় হতো সাত টাকা। ব্লেয়ার ক্লিং বলেছেন প্রতি বিঘা জমিতে নীল চাষ করলে তার আয় হতো এর এক-তৃতীয়াংশেরও কম। ১৮৫৭-৫৮ সালের মহাবিদ্রোহের পরে যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, তাতে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকে। নীলের দামও কিছু বেড়েছিল। কিন্তু তাতে কৃষকরা উৎসাহ বোধ করে নি। কারণ উৎপাদন খরচ বেড়েছিল আরও বেশি। লাঙল, বলদ সব কিছুরই দাম বেড়েছিল। এই পরিবর্তিত বাস্তব পরিস্থিতিতেই কৃষকেরা নীল চাষকরতে অস্বীকৃত হয়। ১৮৫৬ সালে বারাসতের কিছু রায়ত নীল চাষে অস্বীকৃত হওয়ায় দাঙ্গা হাঙ্গামা বাঁধে। তারা ম্যাজিস্ট্রেটকে বলেছিল যে, নীলের মত অলাভজনক জিনিস চাষ না করে তারা তামাক বা অন্যান্য লাভজনক জিনিস চাষ করতে চায়। এইভাবে অর্থনৈতিক কারণে কৃষকেরা যখন মানসিকভাবে বিদ্রোহের জন্য তৈরী হচ্ছিল তখন নীলচাষের কুফল নিয়ে দেশীয় পত্র পত্রিকায় অনেক রচনা প্রকাশিত হচ্ছিল। আবার ১৮৪৯ সালের "ব্ল্যাক বিল” নিয়েও চারদিকে হৈ চৈ হচ্ছিল। প্রস্তাবিত এই বিলে স্থানীয় ফৌজদারী আদালতে ইংরেজদের বিচার করার কথা বলা হয়েছিল। নীলকর সাহেবরা এর তীব্র বিরোধিতা করেছিল। বাঙালী বুদ্ধিজীবী সমাজ এর তীব্র সমালোচনা করেছিল। তারা এর মধ্যে বর্ণবৈষম্য নীতির অশুভ ছায়া দেখেছিল। ১৮৫১ সালে British Indian Association এর প্রতিষ্ঠা আর একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এইসব ঘটনা কৃষকদের মনে উৎসাহের সঞ্চার করেছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল যে, তারা একা নয়। আবার ঠিক এই সময়েই সরকারও ক্রমশঃ নীলকরদের কার্যকলাপ সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। দীর্ঘদিন ধরেই নীলকরদের অত্যাচার সরকারের বিড়ম্বনার কারণ হ'য়ে দাঁড়াচ্ছিল। তা সত্ত্বেও সরকার যে কোন নীলকর বিরোধী নীতি গ্রহণ করে নি. তার কারণ হলো ঔপনিবেশিক অর্থনীতিতে নীলের গুরুত্ব। কিন্তু ১৮৫০ এর দশকের আগেই নীলের গুরুত্ব কমতে থাকে। ১৮৪২ সালে কলকাতা থেকে যে সব জিনিস রপ্তানি হতো, তাতে নীল রপ্তানির পরিমান ছিল ৪৬ শতাংশ। ১৮৫০ সালের মধ্যে এর পরিমান কমে দাঁড়ায় মাত্র ১০ শতাংশ। নীলকরদের বিরুদ্ধে ভারত ও ইংল্যাণ্ড উভয় স্থানেই উদারনৈতিক মতাবলম্বী মানুষ সোচ্চার হ'য়ে ওঠে। এই অবস্থায় বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর হয়ে আসেন গ্রান্ট ১৮৫৯ সালে। তিনি উদারনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি চান যে, নীলকরেরা আইন কানুন মেনে চলুক। যতদিন সরকার নীলকরদের বিরোধিতা করে নি, ততদিন কৃষকরা বিদ্রোহ করার মনোবল খুঁজে পায়নি। সরকারের এই পরিবর্তিত নীতি তাই স্বাভাবিকভাবেই নীলকরদের উৎসাহিত করেছিল। ১৮৫৪ সালে যশোহরের ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট আবদুল লতিফ ও ১৮৫৫ সালে নদীয়ার ম্যাজিস্ট্রেট ম্যাঙ্গেলস্ নীলকর সাহেবদের জোর করে চাষীদের নীল চাষ করার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে এগিয়ে এলে রায়তরা সাহসী হয়ে ওঠে ও অনেক জায়গায় নীল চাষ বন্ধ করে দেয়। এর পর বারাসতের ম্যাজিষ্ট্রেট এডেন একটি পরোয়ানা জারী করে বলেন যে, চাষীরা তাদের জমিতে কি ফসল উৎপাদন করবে, তা তাদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার। এডেনের এই পরোয়ানা কৃষকদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। নীল বিদ্রোহ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
নীল বিদ্রোহ যে সমস্ত স্থানে ছড়িয়ে পড়ে :
দ্রুতগতিতে নীল বিদ্রোহ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৮৬০ সালের মধ্যে এই বিদ্রোহ নদীয়া, বারাসত, যশোহর, পাবনা, রাজসাহী, মালদা, ফরিদপুর এবং মুর্শিদাবাদ জেলায় ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। সর্বত্রই কৃষকেরা দৃঢ়ভাবে জানিয়েছিল যে, তারা নীলের চাষ করতে সম্মত নয়। তারা কিন্তু গোড়াতেই কোন সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তুলতে চায় নি। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা শান্তিপূর্ণ পথে আবেদন নিবেদনের মাধ্যমে তাদের অভাব অভিযোগের প্রতিকার প্রার্থনা করেছিল। কিন্তু এই পদ্ধতি ব্যর্থ হওয়ায় এবং নীলকর সাহেবরা বল প্রয়োগের চেষ্টা করায় বিদ্রোহ ক্রমশঃ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। নীলকর সাহেবরা তাদের লাঠিয়াল ও ভাড়াটে গুণ্ডাদের দিয়ে চাষীদের ঘরদোর ও গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে থাকে। চাষীরাও লাঠি, বর্শা, তীর, ধনুক প্রভৃতি অস্ত্র নিয়ে নীলকরদের আক্রমণ করতে থাকে। আন্দোলনের তীব্রতায় ভীত হয়ে বাংলা সরকার ১৮৬০ সালের মার্চ মাসে একটি।আইন জারী ঘোষণা করেন যে, চুক্তিভঙ্গ করে নীল চাষ না করা আইনতঃ দণ্ডনীয়। সঙ্গে সঙ্গে নীলকর সাহেবরা এই আইনের সুযোগ নিয়ে চুক্তি ভঙ্গ করার জন্য কৃষকদের বিরুদ্ধে আদালতে অসংখ্য মামলা দায়ের করে। বলা বাহুল্য বিচারকগণ নীলকরদের পক্ষে রায় দেন। বহু চাষীর সাজা হয় এবং অনেকেই নীল চাষ করতে বাধ্য হয়। এই আইন জারী করা হ'য়েছিল সাময়িক কালের জন্য। অক্টোবর মাসে এর মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় গ্রান্ট তা আর নবীকরণ করলেন না। এর ফলে রায়তদের সুবিধা হয়। এর পর আন্দোলন ক্রমশঃ চরম আকার ধারণ করতে থাকে। তারা জমিদারদের কর দেওয়া বন্ধ করে। নীলকরদের অনেকেই ছিল জমিদার। তারা প্রজাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করতে থাকে। প্রজারাও পিছিয়ে রইলো না। তারা আদালতে মামলা করে দাবী করলো যে, ১৮৫৯ সালের দশম আইন অনুযায়ী তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করার কোন অধিকার জমিদারের নেই। আদালতে নীলকর সাহেবরা সুবিধা করতে পারলো না। ১৮৬৩ সালের মধ্যেই বিদ্রোহ প্রায় অবসান হয়। নীলকর সাহেবরা নীলের জন্য বর্ধিত মূল্য দিতে বাধ্য হয়। অনেকে নীলের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়। শেষ পর্যন্ত বাংলা দেশে নীলের ব্যবসা কার্যতঃ ধ্বংস হয়ে যায়। নীল চাষীদের আন্দোলন সফল হয়।
নীল বিদ্রোহে যে সমস্ত ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেছিল :
এবার আসা যাক নীল বিদ্রোহে কারা অংশ নিয়েছিল, কাদের হাতেই বা ছিল নেতৃত্ব এই সব আলোচনায়। এ সব প্রশ্নকে কেন্দ্র করেও ঐতিহাসিকদের মধ্যে তর্ক বিতর্ক ও মতভেদ আছে। কোন বিতর্ক বা মতভেদ সম্ভবতঃ দেখা দেবে না, যদি আমরা বলি যে, এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল তারাই, যারা নীল চাষ পছন্দ করে নি, বা যারা নীলকরদের উপর আদৌ সন্তুষ্ট ছিল না। নীল চাষে বা নীলকরদের সঙ্গে যারা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নয়, বা যাদের কোন স্বার্থ সরাসরিভাবে এর সঙ্গে যুক্ত ছিল না, তারা নৈতিক সমর্থন অবশ্যই জানাতে পারে এবং তা নিয়ে একটা শোরগোল তুলতে পারে, বা এমনকি বিদ্রোহীদের পরামর্শ দিয়ে, অর্থ দিয়ে এবং অন্যান্য নানাভাবে সাহায্য করতে পারে। তবে তাদের এই সমর্থন বা অংশ গ্রহণ অনেকটা বাইরের ব্যাপার। এ ভাবে ব্যাখ্যা করে অবশ্য তাদের ভূমিকাকে খাটো করা আমাদের লক্ষ্য নয়। তাদের নৈতিক সমর্থনের মূল্য ও গুরুত্ব সব সময়েই স্বীকার্য। কিন্তু এর বেশি কিছু করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়, এই বাস্তব কথাটুকুও মনে রাখা উচিত। যাই হোক বিভিন্ন শ্রেণীর পারস্পরিক ভূমিকা ও তার গুরুত্ব সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে তর্ক ও বিতর্ক থাকতেই পারে।
নেতৃত্বের প্রসঙ্গে ডঃ চিত্তব্রত পালিতের বক্তব্য হলো কৃষকেরা এ বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয় নি এবং এ বিদ্রোহ আদৌ স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না। তাঁর মতে ভূস্বামী জমিদার শ্রেণীই এই বিদ্রোহে সব চেয়ে বেশি আগ্রহী ছিল এবং তারাই দিয়েছিল এর নেতৃত্ব। তার কথায় "The landlords were solely responsible for engineering the indigo uprising to knock out their bitterest enemies once and for all.”৬২ তিনি আরও বলেছেন যে, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও কৃষ্ণদাস পালের মত জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা জমিদারদের কাছে খুব প্রয়োজনীয় ছিল, কারণ জমিদারদের বক্তব্য তাঁদের কলম দিয়ে বার হতো। অন্যদিকে ব্লেয়ার ক্লিং ডঃ পালিতের বিরোধিতা করে বলেছেন “কিন্তু এ বিদ্রোহের নেতৃত্ব যে রায়ত থেকে জমিদার পর্যন্ত সকল স্তরে ব্যাপ্ত ছিল, এ সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্যাদি রয়েছে ......এমন অনেক ঘটনা আছে যেখানে রায়তেরা গ্রামপ্রধান ও স্থানীয় জমিদারদের উদ্বুদ্ধ করেছে নীলকরদের বিরুদ্ধে মাঠে নামার জন্যে। আবার এমন ঘটনাও আছে যেখানে ভূস্বামীরা রায়তদের উৎসাহ দিয়েছেনীল চাষ না করার জন্য। অনেক সময় বড় জমিদারগণ তাদের পেয়াদা পাঠিে নীল চাষীদের এই মর্মে আশ্বস্ত করার জন্য যে, এরা নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। করলে সে সংগ্রামে তাঁরা শরিক হবেন। অধ্যাপক বিনয়ভূষণ চৌধুরী স্বীকার করেছেন যে, জমিদাররা নীল চাষ পছন্দ করতো না এবং তাদের সঙ্গে নীলকরদের সম্পর্ক ছিল খুব তিক্ত। কিন্তু তিনি মনে করেন যে, মাত্র অল্প কয়েকজন জমিদারই এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল। তাঁর ভাষায় -"Only a small number of আবার এমন such zamindars activity participated in the movement."8 লেখক ও ঐতিহাসিকও আছেন, যাঁরা মনে করেন নীল বিদ্রোহে নেতৃত্ব এসেছিল কেবলমাত্র রায়তদের কাছ থেকেই। প্রমোদরঞ্জন সেনগুপ্তের বক্তব্য হলো – “নীল কমিশনও রায় দিয়েছিলেন যে, নীলবিদ্রোহের জন্য সরকারী কর্মচারী কিংবা পাত্রী কিংবা বাইরের কোন চক্রান্তকারী কারোর ঘাড়ে দোষ চাপানো যায় না। নীল চাষের গলদপূর্ণ অবস্থাই এই বিদ্রোহের জন্য দায়ী। কৃষকেরা এর দুরবস্থার প্রতিকারের জন্য নিজেরাই নিজেদের সংগঠিত করেছিল এবং এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে গিয়ে পরস্পরকে সাহায্য করেছিল।” তিনি জমিদারদের নেতৃত্বের কথা অস্বীকার করে আর এক জায়গায় লিখেছেন "নীলবিদ্রোহের প্রথম দিকে কয়েকজন বড় জমিদার ও ছোট জমিদার নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করলেও প্রধান নেতৃত্ব এসেছিল কৃষকদের মধ্য থেকেই, বিশেষ করে গ্রামের মোড়লদের মধ্যে থেকে যাঁরা ছিলেন ধনী ও মধ্যবিত্ত কৃষক। সুপ্রকাশ রায়ও অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন এই বিদ্রোহে “কোন অখণ্ড নেতৃত্বের সন্ধান মিলে না।........এই বিশাল গণ বিদ্রোহকে বাহিরের কোন নেতৃত্ব পরিচালিত করিতে আসে নাই। বিদ্রোহী কৃষক সমাজের গণ নেতৃত্বেই ইহা সংগঠিত ও পরিচালিত হইয়াছিল। তিনি মনে করেন মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিদ্রোহীদের পাশে এসে দাঁড়ালেও তা ছিল নিতান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। বরং সামগ্রিকভাবে এই শ্রেণী বিদ্রোহের বিরোধিতাই করেছিল।
ঐতিহাসিকদের এই পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যা সাধারণ পাঠককে বিভ্রান্ত করে। তবে এ বিষয়ে কোন বিভ্রান্তি নেই যে, কৃষক ও জমিদার উভয়েই নীলকরদের উপর রুষ্ট ছিল। কিন্তু নীলকরদের বিরুদ্ধে কৃষকদের অভিযোগ ও ক্ষোভ যতটা স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ, জমিদারদের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই তা ছিল না। কৃষকদের ক্ষেত্রে এই সংগ্রাম ছিল তাদের অস্তিত্ব রক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। জমিদারদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তা ছিল না। তারা নীলকরদের উপর ক্রুদ্ধ হ'য়েছিল তখনই যখন নীলকর সাহেবরা জমিদারী এলাকার প্রজার উপর জমিদারের কর্তৃত্বকে স্বাধীনভাবে হস্তক্ষেপ করেছিল। অর্থাৎ জমিদার ও প্রজা একই উদ্দেশ্যে নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামে নি। তা সম্ভবত্ত ছিল না, কারণ উভয়ের শ্রেণী স্বার্থ এক ছিল না। কৃষকদের মধ্যেও গ্রাম প্রধান বা মোড়ল, সম্পন্ন চাষী ও সাধারণ চাষীর স্বার্থ ও লক্ষ্য এক ছিল না। সুতরাং কারা নেতৃত্ব দিয়েছিল বা কারা এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল তা বিচার করার আগে আমাদের বিভিন্ন শ্রেণীর স্বার্থ ও উদ্দেশ্যের মধ্যেকার এই পার্থক্যের কথা। মনে রাখতে হবে। আরও একটি কথা ভুললে চলবে না। তা হলো সাঁওতাল বিদ্রোহে যেমন সিধু-কানুর মত একজন বা দুজন স্বীকৃত নেতা ছিলেন, নীল বিদ্রোহে তা ছিল না। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নেতা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাছাড়া যেহেতু বিদ্রোহে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ সামিল হয়েছিলেন, সেহেতু নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও বৈচিত্র্য থাকা অস্বাভাবিক নয়। যাই হোক সুপ্রকাশ রায় সহ যে সব ঐতিহাসিক এই বিদ্রোহে জমিদারের নেতৃত্বকে অস্বীকার করেছেন, আমরা তাদের সঙ্গে নীল সম্পূর্ণএকমত নয়। বেশ কয়েকজন জমিদার যেমন, সাধুবাটির জমিদার মথুরানাথ আচার্য ও দিকপতি আচার্য, নদীয়া জেলার চণ্ডীপুরের জমিদার শ্রীহরি রায়, নড়াইল এর জমিদার রামরতন রায়, রাণাঘাটের পালচৌধুরী পরিবারের জমিদারেরা গোপাল ও শ্যামচন্দ্র পালচৌধুরী, শিবনিবাসের বৃন্দাবন সরকার এবং অন্যান্য জমিদারদের মধ্যে জগবন্ধু ঘোষ, হরনাথ রায়, নবকৃষ্ণ পাল প্রভৃতি নীল বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য সুপ্রকাশ রায় তাঁর গ্রন্থের মধ্যেই পরস্পরবিরোধী কথা বলেছেন। “ইংরেজ সৃষ্ট এই শ্রেণীটি (অর্থাৎ জমিদার তালুকদার) ইহার সৃষ্টিকর্তা ইংরেজ শাসকগণের পোষিত এবং ইহাদের সমান স্তরের শোষক গোষ্ঠীভুক্ত নীলকর শ্রেণীর বিরোধিতা করিবে ইহা ছিল কল্পনাতীত।....... ইহারা নিজেদের শ্রেণীস্বার্থেই নীল বিদ্রোহের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হইয়াছিল। কিন্তু কিছু পরেই তিনি বলেছেন “ব্যক্তিগতভাবে কোন কোন জমিদার নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ এবং নিজ স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যেই স্থানীয় বিদ্রোহী কৃষকদের সংগঠিত এবং নেতৃত্বও করিয়াছিলেন।”৬৮ক তিনি অবশ্য একই সঙ্গে বলেছেন যে, এই ধরনের জমিদারের সংখ্যা বেশি ছিল না। কিন্তু জমিদারেরা কখনই কৃষকদের স্বার্থে নেতৃত্ব দেন নি এবং কৃষ্ণনগরের ম্যাজিস্ট্রেট হার্সচেলের (Harschel) ভাষ্য উদ্ধৃত করে রণজিৎ গুহ মন্তব্য করেছেন যে, জমিদারেরা এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে এলেও, তারা কখনই তাদের পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করেন নি।৬৯ তাছাড়া যখনই নীলবিদ্রোহ জমিদারী স্বার্থে আঘাত দিয়েছে (কৃষকদের কর না দেওয়ার আন্দোলন, যা জমিদার ও নীলকর উভয়েরই স্বার্থের পরিপন্থী ছিল) তখনই তারা বিদ্রোহ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল; এমন কি নীলকরদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়াতে আসতেও তারা দ্বিধা করেনি। আসলে জমিদারেরা নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধ করার জন্য নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রজা অসন্তোষের পূর্ণ সুযোগ নিয়ে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছিল। তাদের ভূমিকা ছিল সাময়িক।
নীল বিদ্রোহে যারা অংশ নিয়েছিল এবং এমন কি নেতৃত্ব দিয়েছিল, তাদের মধ্যে জমিদার ছাড়া অন্যান্যরাও ছিল। এদের মধ্যে নীলকর সাহেবদের পূর্বতন কর্মচারীরাও ছিল। ঔরঙ্গাবাদের কৃষকদের নেতৃত্ব দিয়েছিল মোরাদ বিশ্বাস নামে নীলকুঠির একজন প্রাক্তন কর্মচারী। যশোহরের কৃষকদের নেতৃত্ব দিয়েছিল রামরতন, রামমোহন ও গিরীশ মল্লিক নামে তিন ভাই। নীল বিদ্রোহের দুজন প্রভাবশালী নেতা দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস এক সময় নীলকুঠির দেওয়ান ছিলেন। অন্যদিকে গ্রামের জোতদার, তালুকদার ও কিছু মহাজনও নীল বিদ্রোহে সামিল হয়েছিলেন। এঁরাই ১৮৫৯ সালে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের কাছে উইলিয়াম হোয়াইট নামে একজন অত্যাচারী নীলকরের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়েছিলেন। এদের মধ্যেই কেউ কেউ, যেমন পোড়াগাছার বিশ্বাসেরা নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছিল। শিশিরকুমার ঘোষও ছিলেন তালুকদার বংশের সন্তান। তবে তাঁর ভূমিকা ছিল স্বতন্ত্র। গ্রামের কিছু ধনী কৃষক ও মোড়ল যারা একদা নীলকর সাহেবদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল। ধনী কৃষকদের উদ্দেশ্য ছিল নীলকর সাহেবদের ক্ষমতা খর্ব করা, যাতে তারা নিজেরাই চুটিয়ে মহাজনী ব্যবসা করতে পারে। অনেক সময় তারাই স্থানীয় স্তরে নেতৃত্ব দিয়েছিল। তবে এই মোড়ল ও ধনী কৃষকরাও নিজেদের স্বার্থছাড়া কিছু বুঝতো না। নীল বিদ্রোহে বাঙালী মধ্যবিত্ত ও খৃষ্টান পাদ্রীদের ভূমিকা সম্পর্কে আগে কিছু বলা হয়েছে। শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণী নীল বিদ্রোহীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হ'লেওএবং অনেক সময় সক্রিয়ভাবে সাহায্য করলেও কখনও সরকার বিরোধী ছিল না। আসলে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সহানুভূতি ছিল অনেকটা লোক দেখানো। তারা যে কতটা কৃষক দরদী ছিল তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল মাত্র কয়েক বছর আগে ঘটে যাওয়া সাঁওতাল বিদ্রোহের ক্ষেত্রে। নীল বিদ্রোহে যারা সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারতো, তারা হলো আইনজীবী সম্প্রদায়। কিন্তু মোক্তার তিনু চক্রবর্তীর মত কিছু আইনজীবী ছাড়া অধিকাংশ আইনজীবী নিজেদের স্বার্থে এবং যতটা সম্ভব গা বাঁচিয়ে কৃষকদের সাহায্য করেছিল। ১৮৫৪ সালে, যখন নীল বিদ্রোহ হয় নি, নদীয়া থেকে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের কাছে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে আবেদন করা হয়েছিল, তার অধিকাংশ স্বাক্ষরদাতা ছিল আইনজীবী; কিন্তু ১৮৫৯ সালে যখন অনুরূপ আর একটি আবেদনপত্র পেশ করা হয়েছিল, তখন তাতে কোন আইনজীবী স্বাক্ষর করেন নি। তবে সংখ্যায় অল্প হলেও কিছু আইনজীবী কৃষকদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু নীলকরদের ভয়ে অনেক আইনজীবী কৃষকদের সাহায্য করতে সাহস পায় নি। অবশ্য এ কথা স্বীকার্য যে, অধিকাংশ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ নীলবিদ্রোহ নিয়ে মাথা না ঘামালেও হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, গিরীশচন্দ্র ঘোষ, শিশিরকুমার ঘোষ, মনমোহন ঘোষ, কিশোরীচাঁদ মিত্র, দীনবন্ধু মিত্র, মধুসুদন দত্ত প্রভৃতি ব্যক্তি বিদ্রোহীদের সমর্থন জানিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই দীনবন্ধু মিত্রের লেখা নীলদর্পণের কথা মনে আসে। নীলদর্পণ তখন বাংলা দেশে ও বাঙালী সমাজে ঝড় তুলেছিল। অনেকেই এই নাটককে হেরিয়েট স্টোর লেখা আঙ্কল টমস কেবিন-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ সমকালীন লেখক নীলদর্পণ সম্পর্কে তাঁদের মূল্যবান বক্তব্য রেখেছেন। আজও নীলদর্পণ নিয়ে বাঙালীর আবেগ, উচ্ছ্বাস ও সমালোচনার অবসান হয় নি। এই নাটক লেখার কিছু পরে, তা মাইকেল মধুসূদন দত্ত কর্তৃক ভাষান্তরিত হয় ও রেভারেণ্ড জেমস্ লঙ্ঙ্গে নামে প্রকাশিত হয়। এর জন্য লঙ্ সাহেবের জরিমানা হয় এবং এই জরিমানার টাকা কালিপ্রসন্ন সিংহ দিয়েছিলেন। এসব ইতিহাসই আমাদের জানা। আমাদের এই আলোচনায় নীলদর্পণের সাহিত্য গুণ সম্পর্কে বা নাটক হিসাবে তা কতটা যথার্থ এবং রসোত্তীর্ণ, সে আলোচনার অবকাশ নেই। তবে দীনবন্ধু মিত্রকে একজন শিক্ষিত বাঙালী মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি হিসাবে নীলদর্পণের মধ্যে বাঙালী মধ্যবিত্তের মানসিকতা কতটা প্রতিফলিত হ'য়েছিল, তা আলোচনা করা যেতে পারে এবং সেই সঙ্গে সামগ্রিকভাবে মিশনারীদের এবং বিশেষভাবে নীলবিদ্রোহে লঙ্-এর ভূমিকা সম্পর্কে দু-চার কথা বলা যেতে পারে। দীনবন্ধু মিত্র সরকারী কর্মচারী ছিলেন। সুতরাং তাঁর পক্ষে সরকারী বিরোধী কোন বক্তব্য রাখা কঠিন ছিল। বস্তুতঃ দীনবন্ধু নীলকর বিরোধী হলেও রাজ বিরোধী ছিলেন না। হিন্দু কলেজের ছাত্র উদারনৈতিক ও প্রগতিশীল আদর্শে দীক্ষিত দীনবন্ধুর একদিকে রাজ ও সরকারী আনুগত্য এবং অন্যদিকে নীলকর বিরোধিতার মধ্যে কোন বিরোধ ছিল। না, কারণ সরকারও তখন নীলকরদের পক্ষে ছিল না। সরকার ও বাঙালী মধ্যবিত্তের নীলকর বিরোধী সহ অবস্থান এই সময় ছিল প্রায় অনিবার্য ও স্বাভাবিক। মনে রাখা প্রয়োজন স্বয়ং লেফটেন্যান্ট গভর্নর গ্রান্ট ও সচিব সীটন কার নীলদর্পণের ইংরেজী অনুবাদ, ছাপা এবং তা বিনামূল্যে বিশিষ্ট ইংরেজদের মধ্যে বিতরণ করতে উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁরা রেভারেও লঙ্ কে নীলদর্পণের ইংরেজী অনুবাদ করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। লঙ্ এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন দুটি উদ্দেশ্যে। প্রথমতঃ তিনি একজন মিশনারী হিসাবে কৃষকদের প্রতি এই অত্যাচার ও শোষণ সমর্থনকরতে পারেন নি। তাই তিনি নিজে নীলকরদের অত্যাচার ও শোষণের স্বরূপ তুলে ধরার জন্য একটি পুস্তিকা রচনা করেছিলেন এবং তা গ্রামাঞ্চলে প্রচারিত হ'য়েছিল। দ্বিতীয়তঃ তিনি চেয়েছিলেন ভারতে ইংরেজ শাসন চিরস্থায়ী হোক। তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে, দেশের মানুষের এই ক্ষোভ ও অসন্তোষের সুযোগ নিয়ে রুশ বা ফরাসী শক্তি ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব বিপন্ন করতে পারে। এই ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্য তিনি সরকারকে সচেতন করতে চেয়েছিলেন। লঙ্ অবশ্য স্বাভাবিক কারণেই নীলকরদের বিরাগভাজন হন, এবং তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। তাঁকে অনেক দুঃখ দুর্দশা ভোগ করতে হয়। যাই হোক বাংলার নীলচাষীদের জন্য তিনি যে মানবিক ও দরদী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন, তার জন্য অকুণ্ঠ প্রশংসা অবশ্যই তাঁর প্রাপ্য। সব পাদ্রী কিন্তু লঙ্-এর মত কৃষক দরদী ছিলেন না। এঁরা অনেকেই চান নি যে, লং সাহেব নীল বিদ্রোহের মত একটি জাগতিক (secular) বিষয় নিয়ে মাতামাতি করুন। সুতরাং নীলের প্রশ্নে পাদ্রীদের মধ্যেও মতবৈষম্য ছিল। দির্শী মানুষের মধ্যে লঙ্-এর জনপ্রিয়তা অনেকেরই হিংসার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাছাড়া বেশ কিছু পাত্রী ছিলেন, যাঁরা নীলকরদের পক্ষে ছিলেন। লও এর কারাবাসের ঘটনা বাঙালী বুদ্ধিজীবীকে গভীরভাবে ব্যথিত করলেও এবং সরকারের কাছে তারা তাঁর কারাবাসের মেয়াদ হ্রাস করার জন্য আবেদন করলেও মিশনারীরা তার বিরোধিতা করেছিল। আরও উল্লেখযোগ্য যে, লজ্ সাহেবের বিচারের আগেই কলকাতার চার্চ মিশনারী সোসাইটি তাঁকে বহিষ্কার করার কথাও চিন্তা করেছিল। সুতরাং মিশনারীদের ভূমিকা সব সময়ে কৃষকদের পক্ষে ছিল এ কথা মনে করার কোন কারণ নেই।
বাংলার ৬০ লক্ষ কৃষক এই বিদ্রোহে অংশ গ্রহণ করলেও তারা যে ঐক্য এবং সাংগঠনিক তৎপরতা ও কৌশল দেখিয়েছিল, তার তুলনা মেলা ভার। কৃষকদের মধ্যে যে ঐক্য ও দৃঢ়তা দেখা গিয়েছিল, কাধে কাধ মিলিয়ে লড়াই করার যে মানসিকতা দেখা গিয়েছিল, তারও প্রশংসা মুক্ত কন্ঠে না করে উপায় নেই। নীল বিদ্রোহ শান্তিপূর্ণ ছিল না। অস্ত্রশস্ত্র শিক্ষার জন্য বহু নাম না জানা নেতা দায়িত্ব নিয়েছিল। এদের রণকৌশল কেমন ছিল, তার বর্ণনা পাওয়া যায় জনৈক জার্মান পাদ্রীর এক রচনা থেকে। এরা দুটি ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানীতে বিভক্ত হ'য়ে যুদ্ধ চালাত। এই সব কোম্পানীতে মহিলারাও অংশ নিত। এই রণকৌশল নদীয়ায় প্রচলিত হলেও মনে হয় অন্যত্রও তা ছিল। অন্যদিকে নীলকরদের লাঠিয়ালদের আক্রমণের হাত থেকে গ্রামবাসী কিভাবে আত্মরক্ষা করতো, তা জানা যায়, অনাথনাথ বসু রচিত 'মহাত্মা শিশির কুমার ঘোষ' নামক গ্রন্থ থেকে। তিনি লিখেছেন - " লাঠিয়ালদের হস্ত হইতে আত্মরক্ষার জন্য কৃষকগণ এক অপূর্ব কৌশল আবিষ্কার করিয়াছিল। প্রত্যেক পল্লীর প্রান্তে তাহারা একটি করিয়া দুন্দুভি রাখিয়াছিল। যখন লাঠিয়ালগণ গ্রাম আক্রমণ করিবার উপক্রম করিত, কৃষকগণ তখন দুন্দুভি ধ্বণিদ্বারা পরবর্তী গ্রামের রায়তগণকে বিপদের সংবাদ জ্ঞাপন করিলেই তাহারা আসিয়া দলবদ্ধ হইত। এই রূপে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই চারি পাঁচখানি গ্রামের লোক একত্র হইয়া নীলকর সাহেবদিগের লাঠিয়ালদের সহিত তুমুল সংগ্রামে ব্যাপৃত হইত। সতীশ চন্দ্র মিত্র রচিত যশোহর খুলনার ইতিহাসেও অনুরূপ বর্ণনা পাওয়া যায় ভারতের কৃষক সংগ্রামের ইতিহাসে নীলবিদ্রোহ চিরদিন এক অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হিসাবে চিহ্নিত থাকবে। ব্যাপকতা, সংগঠন ও প্রকৃতির দিক দিয়ে বিচার করলে এই বিদ্রোহের সঙ্গে সাঁওতাল বিদ্রোহের কিছু সাদৃশ্য পাওয়া যায়। তবে উভয়বিদ্রোহের মধ্যে যেমন কিছু মিল আছে, তেমনি যথেষ্ট অমিলও আছে। সবচেয়ে বড় অমিল হলো এইখানে যে, সাঁওতাল বিদ্রোহ অনেকাংশে ব্যর্থ হলেও নীলবিদ্রোহ সম্পূর্ণরূপে সফল। নীল চাষীদের বিদ্রোহ বাংলাদেশে নীল চাষের প্রায় বিলোপ ঘটিয়েছিল এবং নীলকর সাহেবরা তাদের পুঁজি বাংলা থেকে সরিয়ে বিহারে নিয়োগ করেছিল। নীচে দেয়া সারণী থেকে আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট হবে।কেউ কেউ এই পুঁজি নিয়োগ করেছিল চা-বাগানে। বিদ্রোহের সাফল্য প্রমাণ করলো যে, বাংলার কৃষক সম্প্রদায় দুর্বল ও অসহায় নয়। তারা তাদের স্বার্থ ও অধিকার সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিল। নীলচাষীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকায় লিখলেন - "বাংলাদেশ তার কৃষকদের সম্বন্ধে নিশ্চয় গর্বিত হতে পারে—সরকার ছিল তাদের বিরুদ্ধে, আইন আদালত সবই তাদের বিরুদ্ধে। এই বিপ্লবের জন্য তাদের অসংখ্য দুর্ভোগ ভোগ করতে হচ্ছে—প্রহার, অপমান, গৃহচ্যুতি, সম্পত্তি ধ্বংস সবই তাদের ভাগ্যে ঘটছে, সব রকমের অত্যাচার তাদের উপর হ'য়েছে। গ্রামকে গ্রাম আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, পুরুষদের ধরে নিয়ে কয়েদ করে রাখা হয়েছে, সব রকমের নৃসংশতা তাদের উপরে হ’য়েছে। তবু রায়তরা মাথা নত করে নি। শিশির কুমার ঘোষ ও সতীশচন্দ্র মিত্রও নীলচাষীদের আপোষহীন সংগ্রামের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।
নীল বিদ্রোহের ফলাফল ব্যাখ্যা :
নীল বিদ্রোহের ফলাফল ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ব্লেয়ার ক্লিং মন্তব্য করেছেন যে, এই বিদ্রোহে সাধারণ কৃষক লাভবান হয় নি। গ্রামের ধনী ও সম্পন্ন কৃষকেরা নীলকরদের সরিয়ে তাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করে ও মহাজনী ব্যবসায় লিপ্ত হয়। তাঁর বক্তব্য তাঁর ভাষাতেই বলি— "Many of its members (i.e. rural middle class) from patnidars to village headmen-were engaged in money lending. They supported the ryots only for the sake of undermining the economic power of their arch-rivals, the indigo planters. Ultimately they snatched the fruts of victory from the peasants and the indigo disturbances mark the transfer of power from planter to money lender in lower Bengal." অধ্যাপক বিনয় চৌধুরী ক্লিং-এর এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করে বলেছেন যে, বাংলার কৃষকেরা নীল চাষের অনেক আগে থেকেই মহাজনদের হাতে শোষিত হতো। তাছাড়া তাদের কৃষিযোগ্য জমির অতি সামান্য অংশেই নীল চাষ হতো। তার অভিমত হলো -- "If the position of the money lenders became increasingly stronger later, the disappearance of indigo was scarcely the cause.নীল বিদ্রোহ বাঙালী সমাজকে নাড়া দিয়েছিল। বাংলার কৃষক সম্প্রদায় লক্ষ্য করেছিল যে, সরকার নীলকরদের বিরোধিতা করলেও নীলচাষের বিরোধিতা করে নি। সরকারের এই দু-মুখো নীতির ফলে কৃষকেরা সরকারের সদিচ্ছার উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল। ফলে সরকারকেও তারা তাদের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। তবে সরকার এটাও চায়নি যে, নীলকর সাহেবরা কৃষকদের উপর অত্যাচার করুক। কিন্তু সরকারী নীতি সব সময় স্থানীয় প্রশাসক মানতো না। ফলে অনেক সময় তাদের যোগসাজসে নীলকর সাহেবরা অত্যাচার করতো। এর ফলেও সরকার বিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পেয়েছিল। অন্যদিকে নীল বিদ্রোহ ও বিশেষ করে লঙ্ সাহেবের কারাবাস ও জরিমানা বাঙালী মধ্যবিত্তকে উত্তেজিত করেছিল। ব্রিটিশ - উদারনীতিবাদ সম্পর্কে তাদের মোহ কিছুটা কাটতে শুরু করে। জাতিগত বৈষম্য আরও তিক্ত হ'য়ে উঠতে থাকে। নীল বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে যে জনমত গড়ে উঠেছিল, তা বাঙালী জাতীয়তাবাদের উন্মেষে যথেষ্ট সহায়ক হ'য়েছিল। শিশির কুমার ঘোষের ভাষায়- “এই নীল বিদ্রোহই সর্বপ্রথম দেশের লোককে রাজনৈতিক আন্দোলনের ও সঙ্ঘবদ্ধ হইবার প্রয়োজনীয়তা শিক্ষা দিয়াছিল। বস্তুত বঙ্গদেশে ব্রিটিশ রাজত্বকালে নীল বিদ্রোহই প্রথম বিপ্লব। অবশ্য নীল বিদ্রোহই বাংলাদেশের প্রথম বিপ্লব কিনা, তা নিয়ে তর্ক উঠতে পারে। (প্রসঙ্গতঃ সাওতাল বিদ্রোহের কথা মনে করা যেতে পারে।) তবে নীল বিদ্রোহ যেভাবে বাঙালী মধ্যবিত শ্রেণীকে উত্তেজিত করেছিল, আগে তা হয় নি। অন্যদিকে নীল বিদ্রোহে সরকারী ভূমিকা ছিল যথেষ্ট সংযত ও পরিণত। প্রথমতঃ সরকার নীলকরদের অত্যাচার মেনে নেয় নি। দ্বিতীয়তঃ সাঁওতাল বিদ্রোহ ও প্রায় সদ্য সমাপ্ত ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সরকার কোন দমনমূলক নীতি গ্রহণ করে নি। বরং বিদ্রোহের ব্যাপকতা লক্ষ্য করে ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের, বিশেষতঃ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভূমিকা লক্ষ্য করে সরকার নীল কমিশন বসাতে তৎপর হয়েছিল।
নীল বিদ্রোহে বাংলার কৃষকদের জয় হলেও এবং তাদের ইচ্ছামত ফসল ফলানোর অধিকার স্বীকৃত হলেও, বাংলার কৃষি ব্যবস্থার মূল জটিলতা ও সমস্যা কিন্তু থেকেই গেল। ডঃ চিত্তব্রত পালিত বলেছেন "The Indigo Revolt doubtlessly demonstrated that in a favourable climate, the peasants were capable of asserting their rights and striking the enemy; but they were still at the mercy of the objective conditions which were beyond their control in the mid- 19th century.' নীল বিদ্রোহের সময় জমিদারদের সঙ্গে রায়তদের যে সাময়িক বোঝাপড়া হয়েছিল, তার ফলে জমিদারদের অত্যাচার ও শোষণের বিষয়টি চাপা পড়ে গিয়েছিল। নীল বিদ্রোহ চলাকালীন রায়তেরা যখন কর বন্ধের ডাক দিয়েছিল, তখনই জমিদারেরা একটা বিপদের আভাস পেয়েছিল। ১৮৫৯ সালের দশম আইন তাদের চিন্তিত করেছিল। এই আইনে প্রজাদের যে সমস্ত অধিকার দেয়া হয়েছিল, তা তারা সমর্থন করে নি। নীল বিদ্রোহের পর কৃষকদের উপর জমিদারদের শোষণ ও অত্যাচারের বিষয়টি ক্রমশঃ বাংলার কৃষি সম্পর্ককে জটিল করতে থাকে। কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ এক উত্তেজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ১৮৭০ এর দশকে তা বিদ্রোহের আকারে ফেটে পড়ে। জমিদার বিরোধী এইসব কৃষক বিদ্রোহের মধ্যে সবচেয়ে বেশী উল্লেখযোগ্য হল পাবনা বিদ্রোহ।
0 Comments
If you like the posts, you must comment. and if there is any problem , please let me know in the comments.