চীনে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার পটভূমি।Chinese Communist Party leadership Analyze the impact of the rise of Communist China on international politics(F.M-20)
সূচনা :-
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে আন্তর্জাতিক রাজনীতির পক্ষে এশিয়ার মানচিত্র সবথেকে উল্লেখযোগ্য ঘটনা চীনে কমিউনিস্ট শাসন ব্যবস্থার পত্তন (1949 খ্রিস্টাব্দ 1 অক্টোবর)। পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এর কবল থেকে মুক্ত হয়ে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র রূপে আত্মপ্রকাশ করে চীন এশিয়াতে তথা বিশ্বের রাজনীতিতে ভারসাম্য আনে। ঐতিহাসিক ফ্রিডমানের মতে --আধুনিককালের আন্তর্জাতিক ঘটনার ক্ষেত্রে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় শক্তি রূপে চীনের অভ্যুদয় ("The emergence of China as a unified national power under communist leadership is the most important international event")
চীনের স্বাধীন সত্তা :-
চীনের এক বিশাল দেশ। ভৌগোলিক আয়তনের দিক থেকে চীনের স্থান পূর্বতন সোভিয়েত রাশিয়া ও কানাডার পরেই। এশিয়া মহাদেশের পূর্ব প্রান্তে 'সুদূর প্রাচ্য' বলে পরিচিত স্থানে অবস্থিত চীনের ভৌগোলিক অবস্থান ও খুব গুরুত্বপূর্ণ। চিনো চতুর্দিক বেষ্টন করে আছে ভারত, পাকিস্তান, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অনেক দেশ। বিশাল ভূখণ্ড ও বিপুল জনসংখ্যা সমন্বিত চীন খনিজ সম্পদেও সমৃদ্ধিশালী। এখানে প্রায় 140 ধরনের খনিজ সম্পদ পাওয়া যায়। এই ধরনের একটি সমৃদ্ধশালী দেশ এতদিন ছিল বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। উনিশ শতকের মধ্যভাগে অহিফেন যুদ্ধের (Opium War) সময় থেকে চীনের ওপর বিদেশিদের শোষণ ও অত্যাচার চলতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট চীনের প্রধান স্থপতি ও রূপকার মাও-সে-তুং ক্লান্ত ,যুদ্ধবিধ্বস্ত, আত্মমর্যাদাহীন একটি জাতির প্রাণে নবজীবনের সঞ্চার করেন। মাও- সে -তুং হৃত সর্বস্ব চীনাদের মনে আত্মচেতনা ফিরিয়ে দেন এবং জাতি হিসাবে তারা জনগণের সামনে মাথা তুলে দাঁড়ায়।
সাম্যবাদী শিবিরে শক্তিবৃদ্ধি:-
বিশ্বের দ্বিমেরুকরণ রাজনীতিতে চীনের উত্থান সাম্যবাদী শিবিরে প্রবল শক্তি বৃদ্ধি ঘটায়। চীন ও বিশ্বের অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্ব একটি শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক শিবির গঠন করে। চিয়াং-কাই-শেক এর শাসনকালে তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের একটা পরোক্ষ আধিপত্য ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে মার্শাল এইড বা অন্য কোন মার্কিন সাহায্য ছাড়াই কমিউনিস্ট চীন বিশ্ব রাজনীতিতে এককভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। এই কারণেই কোরিয়া, ভিয়েতনাম বা অন্যান্য দেশের সমস্যায় সে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পেরেছে।
সাম্যবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব :-
সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে চীনের মৈত্রী বিশ্বে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তোলে। রাশিয়া ওই আন্দোলনকে জোরদার করতে নানাভাবে চীনের শিল্পায়ন, সমরসজ্জা, ইত্যাদির ক্ষেত্রে সাহায্য করতে থাকে। শুধু তাই নয়, 1955 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সোভিয়েত রাশিয়া চীনকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে সহযোগী নেতৃত্বের আসনে বসায়। এর ফলে চীন একদিকে যেমন এশিয়ার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, অন্যদিকে তেমনি সোভিয়েত ও তার সহযোগীদের বিবাদে মধ্যস্থতা করে গেছে।
সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক:-
চীনের সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সোভিয়েত রাশিয়ার যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। চীনের লাল বিপ্লব সাম্যবাদী বিশ্ব গড়ে তোলার পথে ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ সোপান। কমিউনিস্ট রাষ্ট্ররূপে চীনের আত্মপ্রকাশের পর সোভিয়েত রাশিয়ায় প্রথম তাকে স্বীকৃতি জানিয়েছিল। বন্ধুত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ উভয় দেশের মধ্যে 30 বছরের জন্য মৈত্রী চুক্তি (1950 খ্রিস্টাব্দ) স্বাক্ষরিত হয়। এর সুফল রূপে সোভিয়েত রাশিয়ার কাছ থেকে চীন সহজ শর্তে 300 কোটি ডলার ঋণ পায়। এছাড়াও রাশিয়া পোর্ট আর্থার বন্দর ও মঞ্চুরিয়া রেলপথের অধিকার চীনের হাতে তুলে দেয়।
বন্ধুত্বের ফাটল :-
কিন্তু 1957 খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে চীন- সোভিয়েত বন্ধুত্বের ফাটল ধরে। 1959 খ্রিস্টাব্দে ক্রুশ্চেভের মার্কিন সফরকে চীন পুঁজিবাদী শক্তির সঙ্গে আপোষ বলেই মনে করে। অবশেষে 1960 খ্রিস্টাব্দে চীন -সোভিয়েত মৈত্রী ছিন্ন হয়ে যায়। সেসময়কার সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী ক্রুশ্চেভ এর নির্দেশে চীন থেকে সোভিয়েত রাশিয়ার সব প্রযুক্তিবিদ, অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক পরামর্শ দাতাদের ফিরিয়ে আনা হয়। আসলে এই দ্বন্দ্বের মূলে ছিল ক্রুশ্চেভের স্ট্যালিন বিরোধী নীতি যা চিন মেনে নিতে পারেনি এবং মাও-সে-তুং-এর স্বাধীন মনোভাব। এছাড়া কমিউনিস্ট চীন ন্যাটো কে সমর্থন করলে বেইজিং ও মস্কোর দ্বন্দ্ব দীর্ঘস্থায়ী হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক:-
চীন সোভিয়েত সম্পর্কের মতো চীন-মার্কিন সম্পর্ককেও পর্যায়ক্রমে নানা ওঠাপড়া ছিল।চীন-মার্কিন সম্পর্কের ও দুটি পর্ব ছিল। প্রথমটি 1949 থেকে 1971 সাল পর্যন্ত বিস্তৃত। এবং দ্বিতীয় পর্বের সূচনা হয়েছিল 1971 খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্ত পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। প্রথম পর্বের চীন-মার্কিন সম্পর্কের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল একটানা ধারাবাহিক সংঘাত ও বিরোধ, উইলফ্রিড ন্যাপ এর ভাষায়, "One element of Chinese foreign policy was clear, and that was it's hostility to the United States "-- A History of War and peace , 1939-1965, p.263
মার্কিন -চীন সম্পর্ক প্রথম পর্ব, অবনতি:-
চীনের সঙ্গে প্রথম দিকে আমেরিকার সম্পর্ক ছিল বৈরিতার। 1949 খ্রিস্টাব্দে মাও এর নেতৃত্বে চীনে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন আত্মপ্রকাশ করলে মার্কিন-চীন সংঘাত শুরু হয়। চীনের কমিউনিস্ট বিরোধী চিয়াং- কাই-শেক কে সমর্থন করা, রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাম্যবাদী চীনের সদস্যপদ এর বিরোধিতা করা বা কোরিয়া যুদ্ধের সময় চীনের মূল ভূখণ্ড আক্রমণ,মার্কিন বিমানবাহিনী চীনের আকাশসীমা লঙ্ঘন ও পরমাণু বোমা নিক্ষেপের হুমকি দেওয়া ইত্যাদির ফলে মার্কিন-চীন সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এর ফল স্বরূপ কমিউনিস্ট চীন ও মার্কিন বিদেশ নীতির বিরোধিতা করেন। কাগুজে বাঘ বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সমালোচনা করে। কোরিয়া যুদ্ধের পরে আমেরিকাকে সরাসরি 'শত্রু' বলে ঘোষণা করলে, চীন ও আমেরিকারকে 'পয়লান ম্বর শত্রু' বলে পাল্টা ঘোষণা করেছিল। 1964 সালে চীন পারমাণবিক বোমা বানাতে সক্ষম হলে 1966 সালে মার্কিন বিদেশ সচিব Dean Rusk ঘোষণা করেছিলেন প্রয়োজনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শক্তি প্রয়োগ করে চীনের কমিউনিস্ট সরকার কে উৎখাত করতে পিছপা হবে না।
সম্পর্কের উন্নতি:-
চীন মার্কিন সম্পর্কের দ্বিতীয় পর্বের সূচনা হয়েছিল 1970 এর দশক থেকে। চীনের সামরিক ও বৈজ্ঞানিক উন্নতি, রুশ-চীন দ্বন্দ্ব ইত্যাদি ঘটনা মার্কিন চীন সম্পর্কের উন্নতিতে সাহায্য করে। 1974 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ চীন 17 টি পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায় এবং বেশ কিছু পারমাণবিক বোমা তৈরি করে ফেলে। স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ ব্যবস্থাতেও চীন দক্ষতা অর্জন করে। 1972 খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রসঙ্ঘে চীনের অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব কে আমেরিকার স্বাগত জানাই। 1971 খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত চীন-মার্কিন 'পিং পং' কূটনীতির সূত্রপাত ঘটে। মার্কিন বিদেশ সচিব স্যার হেনরি ফিসিংগার চীন সফরে যান (1971 জুলাই)। এবং দুই মার্কিন রাষ্ট্রপতি নিক্সন, রেগণ চীন সফরে আসেন। আবার চীনা মন্ত্রী বেন -সিয়াং -পিং মার্কিন সফরে গেলে চীন মার্কিন কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটে।
উন্নতি :-
1972 সালের চীন-মার্কিন শিখর বৈঠকের গুরুত্ব সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, "It was historic because the leader of the the world's most powerful nation and leader of the the world's potentially more powerful nation met after long years of open hostility'' এখন থেকে মার্কিন প্রশাসন চীনকে 'Most favoured Nation ' বা বাণিজ্যের নিরিখে সবচেয়ে ভালো সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের মর্যাদা দান করে। 1989 খ্রিস্টাব্দে চীন-মার্কিন পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সুগঠিত গড়ে তোলে।
গুরুত্বপূর্ণ এসো শক্তি:-
এতদিন কমিউনিস্ট ভাবধারা ও তার আধিপত্য সোভিয়েত রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপেই সীমাবদ্ধ ছিল। এবার কমিউনিস্টের উত্থানের পর তা এশীয় ভূখণ্ডেও ছড়িয়ে পড়ল। ফলের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে। চীনকে উপেক্ষা করে যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শক্তিসাম্য নির্ধারণ করা আর সম্ভব নয়, এবার সকলেই তা উপলব্ধি করে। এভাবে অচিরেই চীন এশিয়ার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতে প্রভাব :-
শুধু এশিয়া মহাদেশেই নয়, উন্নয়নশীল তৃতীয় বিশ্বের নেতা হিসেবেও চীন নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। কমিউনিস্ট চীনের প্রতিষ্ঠার পর ভারত, পাকিস্তান, মঙ্গোলিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি এশীয় দেশ এবং তানজানিয়া, মালি ,গিনি, কঙ্গো, জাম্বিয়া প্রভৃতি আফ্রিকান রাষ্ট্র চীনের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করে চিনও জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলন কে শক্তিশালী করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জহরলাল নেহেরু সঙ্গে চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ- এন -লাই এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ফলশ্রুতি হিসেবে জেনেভা (1954 খ্রিস্টাব্দ) ও বান্দুং (1955 খ্রিষ্টাব্দ) সম্মেলনে চীন বৃহৎ শক্তির মর্যাদা লাভ করে।
বর্তমান বিশ্বে এক শক্তিধর রাষ্ট্র রূপে চীন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছে। তবে পারমাণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতে চীন স্বাক্ষর করতে আপত্তি জানালে তৃতীয় বিশ্বে চিন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। বিশ্বে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে চীনের উত্থান অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। লেনিনবাদের পথ ধরে মাও সে তুং এবং দোং - জিয়াও -পিং যে তত্ত্বের অবতারণা করেছেন তাতেই লুকিয়ে রয়েছে আধুনিক সাম্যবাদের মূল সত্য, যার সঙ্গে মিশে রয়েছে ফ্রেডারিক এঙ্গেলস এর এই উক্তিটি -সাম্যবাদ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা নয় যা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, সাম্যবাদ আমাদের কাছে একটি আদর্শ যার সঙ্গে বাস্তবের মিলন ঘটাতে হবে। আমরা সাম্যবাদ কে সত্যিকারের আন্দোলন বলি যা বর্তমান অবস্থার অবসান ঘটায়।।
" সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশা করি আমাদের এই পোস্টটি আপনার ভাল লাগল। আপনারা যদি এই পোস্টটি সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে,তাহলে নিচে কমেন্ট এর মাধ্যমে আমাদেরকে জানাতে পারেন এবং অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার করে অপরকে জানাতে সাহায্য করুন "
***ইতিহাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর বিস্তারিত অনেক নোট পেতে আমাদের সাইটের পরের পেজ গুলো দেখুন***
0 Comments
If you like the posts, you must comment. and if there is any problem , please let me know in the comments.