চীনে কুয়ো-মিন-তাং (KMT) দলের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ /The establishment and development of the Kuo-Min-Tang (KMT) party in China:
চীনে গুপ্ত সমিতি গঠনের প্রবণতা বরাবরই ছিল। চীনা জাতীয়তাবাদের জনক ডাঃ সান-ইয়াৎ সেন চীনের বিভিন্ন বৈপ্লবিক সংস্থাগুলোকে একসূত্রে গ্রথিত করার চেষ্টা করেছিলেন। এই প্রচেষ্টার পরিণতি হল তুং-মেং-হুই (Tung-Meng-Hui)। এই সংস্থা গঠনের উদ্দেশ্য ছিল ঃ (১) মাঞ্চু রাজবংশের উচ্ছেদসাধন, (২) জনগণের ভোটের দ্বারা নির্বাচিত এক শক্তিশালী প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, (৩) চীনে এক জাতীয় সার্বভৌম সরকার গঠন এবং জমির সমবণ্টন করা। এই উদ্দেশ্যগুলো পূরণের জন্য তিনি চীন বিপ্লবকে তিনটি পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সেগুলি হল : (১) এক সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা, (২) জনগণকে রাজনৈতিক শিক্ষাদান এবং (৩) শেষ পর্যায়ে চীনে একটি সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা। ডাঃ সানের বক্তব্য বহু চীনাবাসীর মনকে দোলা দিয়েছিল। এই দল চীনে প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রধান হাতিয়ার হয়েছিল।
তুঙ-মেং-হুই দল গঠনের ক্ষেত্রে ডাঃ সান-ইয়াৎ সেনের মধ্যে পশ্চিমি প্রভাব ছিল। এই দলের রাজনৈতিক ও আর্থিক পরিকল্পনার মডেল তিনি পশ্চিমি সভ্যতা থেকে গ্রহণ করেছিলেন। এই দলে গুপ্ত সমিতির সব বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রত্যেক সদস্যকে গোপনীয়তা রক্ষা করতে হত। নেতার প্রতি আনুগত্য দেখাতে হত। এই সংগঠনটি ছিল মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এই দল প্রতিষ্ঠার পর চীনে দ্রুত বৈপ্লবিক চিন্তাধারার বিকাশ ঘটেছিল। চীনে এক নতুন পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। বিপ্লবকে সঠিক পথে পরিচালনা করার জন্য সান এই দলের এক সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা ও মতবাদ প্রণয়ন করেছিলেন।
ডাঃ সান-ইয়াৎ সেন বিপ্লবকে বাস্তবায়িত করার জন্য 'জনগণের তিন নীতি' ঘোষণা করেছিলেন। এগুলি হল জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং জনগণের জীবিকা। তুঙ-মেং-হুই দল সানের এই তিনটি নীতির প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। এই দল সানের এই তিনটি নীতিকে কার্যকর করার জন্য ব্যাপক প্রচার চালিয়েছিল। এই দলের মুখপত্র মিন বাও (The People) এই তিন নীতির বিশদ ব্যাখ্যা জনগণের সামনে তুলে ধরেছিল। ‘মাঞ্চুদের বিতাড়ন করা’, ‘চীনকে শক্তিশালী' করার শ্লোগান এই দল গ্রহণ করেছিল। তারা জমির মালিকানার ক্ষেত্রে সমতা প্রতিষ্ঠা করার নীতি গ্রহণ করেছিল। ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ সাম্য, স্বাধীনতা ও মৈত্রীর নীতিকে এই দল গ্রহণ করেছিল। এই দল তাদের ইস্তাহারে বলেছিল, "In the past there was heroes' revolutions to day we need a people's revolution." অর্থাৎ অতীতে বীরদের বিপ্লব হয়েছে, বর্তমানে প্রয়োজন জনগণের বিপ্লব। এই দলের জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১৯০৬ সাল নাগাদ এই দলের সদস্য সংখ্যা ৯৬৩ জনে দাঁড়িয়েছিল। চীনের বাইরে যেমন সিঙ্গাপুর, হনলুল, সানফ্রান্সিসকো এবং ব্রাসলসে এই দলের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই দল সান-ইয়াৎ সেনের নেতৃত্বে বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ডাঃ সান ইয়াৎ সেন চীনা জাতীয়তাবাদের জনকে পরিণত হয়েছিলেন। বিদেশ থেকে চলে আসা ছাত্রদল, প্রগতিবাদী পণ্ডিত সমাজ ও সামরিক অফিসারগণ সকলেই দলকে সমর্থন করলে চীনের ইতিহাসে দীর্ঘদিনের রাজতন্ত্রের অবসান হয়েছিল। নতুন প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন ডাঃ সান-ইয়াৎ সেন। তিনি মাত্র ৪৫ দিন ওই পদে ছিলেন। নবগঠিত শিশু প্রজাতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য তিনি স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রপতি পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিছু শর্তসাপেক্ষে সামরিক অফিসার ইউয়ান সি-কাই চীনের প্রজাতন্ত্রের কর্ণধার হয়েছিলেন। ক্ষমতার মোহে ইউয়ান ি কাই বিপ্লবীদের শর্তকে মেনে নিয়েছিলেন। শর্তগুলি ছিল এরূপ : (১) নানকিং হবে প্রজাতান্ত্রিক চীনের রাজধানী, (২) ইউয়ান নানকিং-এ উপস্থিত হয়ে শপথ গ্রহণ করবেন, (৩) চীনে যে সংবিধান রচনা করা হয়েছে তিনি তাকে মানবেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, ইউয়ান শপথ গ্রহণের দিন থেকেই বিপ্লবীদের শর্তগুলোকে ভাঙতে শুরু করেছিলেন। শর্ত ছিল তিনি নানকিং-এ এসে শপথ নেবেন। কিন্তু তিনি নানা অজুহাতে নানকিং-এ মা এসে পিকিং-এ শপথ গ্রহণ করেছিলেন। এই ঘটনা থেকেই অনুভব করা গিয়েছিল তার হাতে শিশু প্রজাতন্ত্রের ভবিষ্যত নিরাপদ নয়।
তুং-মেং-হুই দলের মধ্যে কোনো ঐক্য ও সমন্বয় ছিল না। এই দলের সাংগঠনিক দুর্বলতাকেও অস্বীকার করা যায় না। পরিণতিতে এই দলের মধ্যে মতভেদ শুরু হয়েছিল। দলের সভ্যদের মধ্যে শ্রেণী চরিত্রের কোনো সামঞ্জস্য ছিল না। সভ্যদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের লোক ছিল। যেমন—বুর্জোয়া, আধা বুর্জোয়া, মাঞ্চুবিরোধী জমিদার শ্রেণী ইত্যাদি। এই দলের অনেক সভ্য আবার গুয়াং-ফু-ই বা হুয়া-শিং হই প্রভৃতি দলেরও সভ্য ছিলেন। ওয়াং-ফু ওই দলের লক্ষ্য ছিল মাঞ্চু শাসনকে ধ্বংস করা। অন্যদিকে হুয়া-শিং-এই দলের উদ্দেশ্য ছিল মা শাসনের অবসান ঘটিয়ে চীনে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করা । এই সব দলের সদস্যরা তুং-মেং-এই দলে যোগদান করলেও তাদের পূর্বতন চিন্তাকে ত্যাগ করতে পারেনি। তাদের সঙ্গে সানের চিন্তাধারার সাদৃশ্য ছিল না। মতাদর্শগত বিরোধ থাকার জন্য এই দল কার্যক্ষেত্রে তেমন শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি তা বলাই বাহুল্য। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছিল ইউয়ান সি-কাই। তিনি এই দলের সভ্যদের মতামতকে গুরুত্বদিতেন না। পরিণতিতে ১৯১২ সালের জুন মাসে তুং-মেং-হুই দলের চারজন মন্ত্রী। ইউয়ান সি-কাই-এর মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। কুটকৌশলী ইউয়ান-সি-কাই তখনও বিপ্লবীদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলার নীতি গ্রহণ করেছিলেন।
অস্থায়ী সংবিধান অনুযায়ী সরকার গঠনের ছয় মাসের মধ্যে একটি পার্লামেন্ট নির্বাচনের কথা ছিল। ১৯১২ সালের আগস্ট মাসে সরকার নির্বাচন সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করেছিল। একটি দুই কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। ১৯১২ সালের আগস্ট মাসে তুং-মেং-হুই এবং অন্য চারটি রাজনৈতিক দলকে নিয়ে সুং-চিয়াও জেন একটি নতুন রাজনৈতিক দল কুয়ো মিনতাং (KMT) গঠন করেন। বিপ্লবী নেতাদের মধ্যে সুং-এর স্থান ছিল ডাঃ সান-ইয়াৎ সেন ও হুয়াং-শিং-এর পরেই। KMT দল দলীয় সরকার গঠন, ক্যাবিনেট প্রথার প্রবর্তন এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমিত রাখার নীতি ঘোষণা করেছিল। স্বাভাবিকভাবে KMT দলের ঘোষিত নীতি ইউয়ানকে বিপদে ফেলেছিল।
১৯১২ সালের ডিসেম্বর মাসে নির্বাচন হয়েছিল। এই নির্বাচনে KMT দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। নির্বাচনে নিম্নকক্ষের ৫৯৬টি আসনের মধ্যে ২৬১টি আসন পেয়েছিল KMI দল এবং উচ্চকক্ষের ২৭৪টি আসনের মধ্যে ১২৩টি আসন KMT দলের ছিল। ঐতিহাসিক ফেয়ারব্যাঙ্ক এই সময়কে চীনা সংসদীয় গণতন্ত্রের উচ্চসীমা বলেছেন।
KMT দল নির্বাচনে সাফল লাভ করলে সুং-চিয়াও-জেনের জনপ্রিয়তা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। তিনি ইউয়ানের দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি হবার বিরোধী ছিলেন না। তিনি সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা ছিলেন। নির্বাচনে সাফল্য পাওয়ার পর তিনি প্রচার করেছিলেন ইউয়ান-সি-কাই রাষ্ট্রপতি থাকতে পারবেন কিন্তু KMT দলের হাতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে। কিন্তু ইউয়ান সি-কাই গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি অনুভব করেছিলেন সুং-এর ধারণা বাস্তবে রূপ পেলে তার হাতে ক্ষমতা থাকবে না। তাই তিনি KMT দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে ভাঙন ধরানোর প্রচেষ্টা শুরু করেন। প্রথমে তিনি সুং-কে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য উৎকোচ দেবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। ১৯১৩ সালের ২০ মার্চ সাংহাই রেল স্টেশনের কাছে সুং-চিয়াও-জেন নিহত হয়েছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে রাষ্ট্রপতি ইউয়ান-সি-কাই-এর ভূমিকা ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঐতিহাসিক ফেয়ারব্যাঙ্কের মতে এই হত্যাকাণ্ড এটা প্রমাণ করেছিল যে, ক্ষমতাসীন ব্যক্তি আইনের ঊর্ধ্বে এবং বিরোধী নেতাকে হত্যা করে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনকে দমন করা যায়। এই সময় গণতান্ত্রিক ও প্রজাতান্ত্রিক দলগুলি মিলিত হয়ে Progressive Party-তে পরিণত হয়েছিল।ইউয়ান-সি-কাই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে উপেক্ষা করে নিজের হাতকে শক্তিশালী করার জন্য তিনি কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। তিনি নিজের দেশ ও জাতির স্বার্থকে উপেক্ষা করে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া, ও জাপানের এক যৌথ ব্যাংক থেকে চড়া সুদে আড়াই কোটি পাউন্ড ঋণ গ্রহণ করেছিলেন। সান-ইয়াং সেন সহ বিপ্লবী নেতারা এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। তাঁরা এই বেআই ঋণ অনুমোদন না করার জন্য পার্লামেন্টের কাছে আবেদন রাখেন। কিন্তু ইউয়ান একে গুরুত্ব দেওয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করেননি। তিনি সংবিধানের শর্তকে উপেক্ষা করে সংসদের কোনো অনুমতি না নিয়েই বিদেশি ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করেছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক ঋণের বোঝায় চীনকে আবদ্ধ করে তার সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করে তোলা। ১৯১৬ সালের ২৭ এপ্রিল এই 'পুনর্গঠন ঋণ (Reorganisation loan) গ্রহণে যে চুক্তি হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল আসল এবং ৫ শতাংশ সুদ সমেত প্রায় ৬৮ মিলিয়ন স্টার্লিং পাউন্ড চীনকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত শোধ করতে হবে। এই প্রতিকূল শর্তের প্রতিবাদে KMT দল বিক্ষোভ দেখিয়েছিল। তারা ইউয়ানের দুর্নীতিপূর্ণ কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বিচারের দাবি তুলেছিলেন। কিন্তু ইউয়ান কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলায় ছিলেন দক্ষ কারিগর। তিনি KMT দলের সভ্যদের মধ্যে ভাঙন ধরান। পার্লামেন্টের অনেক KMT সদস্য দল ছেড়ে ইউয়ানের পক্ষে চলে এসেছিলেন। তাদের তিনি পুরস্কৃত করেছিলেন। প্রত্যেক দলত্যাগী সদস্যকে তিনি ১০০০ স্টার্লিং পাউন্ড দিয়েছিলেন। যেসব KMT সদস্য বিরোধিতা করেছিলেন তিনি তাদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছিলেন।
উত্তর চীনের ওপর রাষ্ট্রপতি ইউয়ান-সি-কাই এর প্রভাব ছিল। কিন্তু দক্ষিণ চীন ইউয়ান-এর কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ছিল। সেজন্য তিনি কিয়াং-সি, কোয়াং-টং এবং আনহুই প্রদেশের গভর্নরদের পদচ্যুত করেছিলেন এবং দক্ষিণ চীন আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। ১৯১৩ সালের জুলাই মাসে কিয়াং সির সামরিক শাসনকর্তা স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এক মাসের মধ্যে আরও ছয়টি প্রদেশের শাসনকর্তা ইউয়ানের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। এই ঘটনা চীনের ইতিহাসে 'দ্বিতীয় বিপ্লব' নামে পরিচিত। কিন্তু বিদেশিরা এই বিদ্রোহকে ঈর্ষাকাতর ও লোভী রাজনীতিবিদদের বিদ্রোহ' বলে উপহাস করেছেন। কিন্তু নিরপেক্ষ বিচারে দেখা যায় এই বিদ্রোহকে বিদেশিরা উপহাস করলেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করার তাগিদ এবং একনায়কতন্ত্রের বিরোধিতা এই বিদ্রোহের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফুটে উঠেছিল। কিন্তু ইউয়ান-সি-কাই এই বিদ্রোহকে দমন করে নিজের শক্তিকে দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রতি ইউয়ানের বিশ্বাসঘাতকতা সান-কে ক্ষুব্ধ করেছিল। তিনি সামরিকএকনায়কতন্ত্রের উচ্ছেদ সাধনের জন্য পুনরায় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। সানের বিদ্রোহকে কঠোর হাতে ইউয়ান দমন করেছিলেন। তিনি KMT দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। সান-কে নির্বাসন দণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। সান জাপানে চলে গিয়েছিলেন। ১৯১৪ সালে জাপানে সান চুংহুয়া কেমিং-টাং (Chunghua Keming Tang) বা চীনা বিপ্লবী দল নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন। এই দলেরও উদ্দেশ্য ছিল ইউয়ান সি-কাইকে ক্ষমতাচ্যুত করা।
দ্বিতীয় বিপ্লবের ব্যর্থতার পর সান বুঝেছিলেন জাতীয়তাবাদী KMT দলের অভ্যন্তরীণ অনৈক্যই হল তাদের ব্যর্থতার মূল কারণ। সেজন্য তিনি জাপানে আশ্রয় নিয়ে জাতীয়তাবাদী দল KMT-কে পুনর্গঠিত করার প্রচেষ্টা শুরু করেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সান-ইয়াৎ সেন নতুন করে KMT দলকে গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর চীনে দ্রুত পরিবর্তন এসেছিল। চীনে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছিল। ৪ঠা মে আন্দোলনের সময় এই জাতীয়তাবাদের প্রকাশ চীনকে এক নতুন সময়ের মুখোমুখি করেছিল। সানের নেতৃত্বে এই সময়ে KMT দল পুনর্গঠিত হয়েছিল। এইসময় KMT দল তার পূর্বের গঠনতন্ত্র ত্যাগ করে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক দলে রূপান্তরিত হয়েছিল। এই দলকে সকলের কাছে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। দলের সংগঠনকে মজবুত করা হয়েছিল। দলের সদর কার্যালয় স্থাপন করে এবং দলের নিয়মবিধি ও কমিটি গঠন করে এই দলকে শক্তিশালী করেছিলেন। জনগণের জন্য তিনি যে তিনটি নীতি ইতিপূর্বে ঘোষণা করেছিলেন তার ওপর ভিত্তি করে এই দলকে পুনর্গঠিত করেছিলেন।
এটা ঠিক যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর চীনের রাজনৈতিক জীবনে যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল, সেগুলি হল : (১) চীনের জাতীয়তাবাদী বা কুয়োমিনতাং দলের পুনর্গঠন এবং (২) চীনের কমিউনিস্ট দলের প্রতিষ্ঠা। এই দুটি ক্ষেত্রেই সোভিয়েত রাশিয়ার প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা ছিল। ডাঃ সান-ইয়াৎ সেন এইসময়ে ক্যান্টনে একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সান মনে করেছিলেন তৎকালীন পিকিং সরকার অবৈধ। কারণ এই সরকারের পিছনে ১৯১৩ সালের নির্বাচিত পার্লামেন্টের কোনো অনুমোদন ছিল না। সান মনে করেছিলেন ক্যান্টনে নতুন সরকার স্থাপন করে তিনি সামরিক অভিযান চালিয়ে পিকিং সরকারকে উচ্ছেদ করবেন। কিন্তু এই চিন্তাকে বাস্তবায়িত করার জন্য দরকার ছিল উপযুক্ত সামরিক বাহিনীর। কিন্তু সানের সামরিক বাহিনী ছিল না। তিনি সমর প্রভুদের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। ক্যান্টনের স্থানীয় সমরনায়ক চেন চিউঙ্গ মিঙ্গ সানকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনিই ১৯২২ সালে সান-কে ক্যান্টন থেকে বিতাড়িত করেছিলেন। সান অন্য সমরনায়কদের সাহায্যে ক্যান্টনে ফিরে এসে চেনকে তাড়ান। এইসব ঘটনা চীনে সমরনায়কতন্ত্রের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেছিল। সান উপলব্ধি করেছিলেন ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রধান উপাদান হল সশস্ত্র সমরবাহিনীর উপস্থিতি। তিনি পিকিং সরকারকে উচ্ছেদ করার জন্য সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন। আমেরিকা সহ সকল দেশের কাছে তিনি সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়া ছাড়া অন্য কোনো দেশ তাঁকে সাহায্য দিতে এগিয়ে আসেনি। কিন্তু মনে রাখা দরকার সোভিয়েত রাশিয়া প্রথম দিকে সানকে সাহায্য দিতে চায়নি। তারা পিকিং-এর জঙ্গি শাসকদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করতে চেয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশ ও জাপানের পরামর্শে পিকিং সরকার রাশিয়ার সঙ্গে কোনো সন্ধি স্বাক্ষর করতে রাজি হয়নি। তখন রুশ সরকার সানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছিল।
ডাঃ সানের রুশ বিপ্লবের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ছিল। বলশেভিকদের সাফল্যের জন্য তিনি ১৯১৮ সালে লেনিনকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। ১৯২০ সালের দ্বিতীয় কমিন্টার্ন কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সোভিয়েত রাশিয়া চীনকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিল। রুশ প্রতিনিধিরা চীনে এসে এটা উপলব্ধি করেছিলেন যে, KMT দল হল চীনের জাতীয়তাবাদের প্রাণকেন্দ্রস্বরূপ। চীনা কমিউনিস্ট দলকে তার KMT-দের সঙ্গে সহযোগিতা করার নির্দেশ নিয়েছিলেন। চীনের কমিউনিস্টরা KMT দলে এসেছিলেন। CCP দলের নেতা লি তা-চাও সর্বপ্রথম KMT দলের সভ্যপদ লাভ করেন। ক্যান্টন সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন মার্কসবাদী চেন-দ্যু-জিও।
ডাঃ সান কতকগুলি কারণে কমিউনিস্টদের KMT দলের সভ্যপদ দিতে রাজি হয়েছিলেন। KMT দলের আদর্শ ছিল যে কেউ এই দলের সভ্য হতে পারত। সাম্যবাদীদের মাধ্যমে সান কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীর ওপর KMT-দের প্রভাব স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। এছাড়াও সেইসময়ে বেশ কিছু সমরপ্রভু সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে নিজেদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করতে চেয়েছিলেন। সমর প্রভুদের শক্তিবৃদ্ধি চীনের পক্ষে ক্ষতিকারক একথা উপলব্ধি করে সান সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন। KMT শ্রমিক শ্রেণী, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সাম্যবাদীদের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনে আগ্রহী হলে সোভিয়েত প্রতিনিধি এডলফ জোফে চীনে এসেছিলেন।
সোভিয়েত প্রতিনিধি জোফে ডাঃ সান-ইয়াৎ সেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। এই সাক্ষাৎকারের পরিণতিতে ১৯২৩ সালের ২৬ জানুয়ারি সান-জোফে ঘোষণাপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এই ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল চীনে এখনও সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার সময় আসেনি। চীনাদের দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য এবং পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সংগ্রাম করতে হবে। সোভিয়েত রাশিয়া সেই সংগ্রামকে সমর্থন জানাবে। সোভিয়েত রাশিয়া চীনের অভ্যন্তরে কোনো সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করবে না। বহির্মঙ্গোলিয়ায় রাশিয়া কোনো সাম্রাজ্যবাদী কার্যক্রম গ্রহণ করবে না।সাম্যবাদী রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হলেও সান ও তাঁর KMT দল কিন্তু তাদের নিজস্ব নীতি থেকে সরে আসেননি। KMT দলের লক্ষ্য ছিল 'জনগণের জন্য তিনটি নীতি' তা যেন বহাল থাকে। KMT দল এই সময়ে CCP-কে ঘোড়া করে নিজে ঘোড়সওয়ার হওয়ার কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিল। KMT দলের কোনো সভ্য CCP দলের সভ্যপদ গ্রহণ করেনি। বরং উল্টো হয়েছিল। আসলে সান কিন্তু সাম্যবাদী ছিলেন না। পশ্চিমি গণতান্ত্রিক দেশগুলোর উপেক্ষা তাকে সোভিয়েত রাশিয়ার সাহায্য নিতে বাধ্য করেছিল। সোভিয়েত রাশিয়াও নিজের স্বার্থে KMT দলকে সাহায্য করেছিল।
সোভিয়েত রাশিয়া থেকে একটি প্রতিনিধি দল চীনে এসেছিল। এই প্রতিনিধি দলের নেতা ছিলেন মাইকেল বোরোদিন। তিনি KMT দলের রাজনৈতিক উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করেছিলেন। KMT দল মাইকেল বোরোদিনের পরামর্শে পুনরায় সংগঠিত হয়েছিল। সান দ্বিধাহীনভাবে ঘোষণা করেছিলেন তিনি সমস্ত পাশ্চাত্য শক্তির ওপর আস্থা হারালেও সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতি তাঁর আস্থা অটুটু আছে।
১৯২৪ সালে KMT দলের প্রথম কংগ্রেসের অধিবেশন বসেছিল ক্যান্টন শহরে। ১৬৫ জন সভ্য এই অধিবেশনে যোগ দিয়েছিল। এই অধিবেশনে সান দলীয় ঐক্য, দলের সংগঠন ও স্বার্থত্যাগের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। অধিবেশন চলার সময়ে ২১ জানুয়ারি বলশেভিক বিপ্লবের নেতা লেনিনের মৃত্যু হয়েছিল। লেনিনের স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য অধিবেশন তিন দিন স্থগিত রাখা হয়েছিল। অধিবেশন পুনরায় শুরু হলে সান সাম্রাজ্যবাদ ও সমরশাসনের বিরুদ্ধে KMT ও CCP-দের মধ্যে ঐক্যের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এই অধিবেশন থেকে ইস্তাহার প্রকাশ করা হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল তারা যৌথভাবে সমরনায়ক ও অসমচুক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে। এছাড়াও এই ইস্তাহারে বলা হয়েছিল চীনে বিকেন্দ্রীকরণ নীতি গ্রহণ করা হবে। সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার, শ্রমিক কৃষকদের স্বার্থরক্ষা, শিল্পের জাতীয়করণ প্রভৃতির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। জনগণের জন্য তিনটি নীতির কথাও বলা হয়েছিল। এই নীতিগুলিকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই নীতিগুলির ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। জাতীয়তাবাদের অর্থ এই পর্বে হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই। গণতন্ত্র বলতে পশ্চিমি ধাঁচের গণতন্ত্রকে বোঝানো হয়নি। জনগণের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। জনগণের জীবিকাকে সমাজতন্ত্রবাদের সমার্থক বলে গণ্য করা হয়েছিল। KMT দলের কার্যসূচিরও পরিবর্তন এসেছিল।
এই কংগ্রেসে KMT দলের সংগঠনও পরিবর্তিত হয়েছিল। মাইকেল বোরোদিনের পরামর্শে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রেসিডিয়াম বা সর্বোচ্চ পরিচালক সভা গঠন করা হয়েছিল। এই পাঁচ সদস্যদের মধ্যে ছিলেন সান এবং লি-তা-চাও। পুনর্গঠিত KMTদলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল সেন্ট্রাল এক্সিকিউটিভ কমিটি বা কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সভা। এই সভায় কয়েকজন কমিউনিস্টকে নেওয়া হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মাও-সে-তুং। নতুনভাবে গড়ে ওঠা KMT দলে কমিউনিস্টদের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মাইকেল বোরোদিন KMT দলের একটি নতুন সংবিধানের খসড়া তৈরি করেছিলেন। গণসমর্থন পাওয়ার কৌশল কীভাবে আয়ত করা যায় তার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও হয়েছিল।
সোভিয়েত রাশিয়ার প্রভাবে KMT দল সাম্যবাদী দলের মতো একটি রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় কমিউনিস্ট দলের মতো KMT দল কখনোই একটি শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত হতে পারেনি। কমিউনিস্ট দলের সদস্যদের মধ্যে যে শৃঙ্খলাবোধ থাকে KMT দলে তা ছিল না। দলের প্রতি ও নেতৃত্বের প্রতি কমিউনিস্টদের যে দায়বদ্ধতা ছিল KMT-র তা ছিল না। এই দলের মতবাদ ছিল অস্বচ্ছ। তাদের দলীয় কর্মসূচি ছিল অপরিকল্পিত। নিজেদের স্বার্থের দ্বারা তারা চালিত হত। সেজন্য এই দল কখনোই CCP-র মতো একটি আদর্শবাদী দল হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।
সোভিয়েত রাশিয়ার সহযোগিতায় KMT দলের সাংগঠনিক পরিবর্তন কেবল হয়নি। এই দলের একটি নির্দিষ্ট মতবাদও গড়ে উঠেছিল। এক্ষেত্রে মাইকেল বোরোদিন সানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। সান KMT দলের মতাদর্শ স্থাপনে নিজের চিন্তা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছিলেন। লেনিনের বক্তব্য ছিল ধনতন্ত্র অনিবার্যভাবে দেশকে সাম্রাজ্যবাদের দিকে নিয়ে যায়। লেনিনের এই বক্তব্যের সঙ্গে সান একমত হননি। জনগণের তিনটি নীতিকে তিনি KMT দলের নীতি হিসাবেই গ্রহণ করেছিলেন। তবে পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই নীতির পরিবর্তনকে তিনি মেনে নিয়েছিলেন। নতুন করে তিনি তিনটি নীতির ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। ধারাবাহিক বক্তৃতার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও জনগণের জীবিকার তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন। KMT দলের প্রথম অধিবেশনে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রী, চীনা কমিউনিস্টদের সঙ্গে সহযোগিতা ও শ্রমিক কৃষক আন্দোলনের বিকাশের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।
KMT দল উপলব্ধি করেছিল কেবল সাংগঠনিক দিক দিয়েই শক্তিশালী হলে চলবে না। চীনের বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর দরকার। মাইকেল বোরোদিন যেমন KMT দলকে সংগঠন হিসাবে শক্তিশালী করেছিলেন তেমনি মাইকেল গ্যালন KMT-র সৈন্যবাহিনী গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিলেন। চিয়াং-কাই-শেক-কে মস্কোতে সামরিক কৌশল আয়ত্ত করার জন্য পাঠানো হয়েছিল। KMT দল ক্যান্টনের কাছে হোয়ামপোয়াতে একটি সামরিক শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেছিল। এই শিক্ষাকেন্দ্রের প্রধান ছিলেন মস্কো থেকে সামরিকপ্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিয়াং-কাই-শেক। তিনি ছাড়াও এই সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গ্যালন ছাড়াও সোভিয়েত পরামর্শদাতারা ছিলেন। এই সামরিক শিক্ষাকেন্দ্রে কমিউনিস্টদের প্রতিনিধি ছিলেন চৌ-এন-লাই।
KMT দলকে পুনর্গঠিত করে সান-ইয়াৎ সেন সমরশাসকদের ও তাদের দোসর সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে চীন থেকে বিতাড়িত করার জন্য উত্তর চীন অভিযানের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। সেই সুযোগ তাঁর কাছে এসেছিল। ১৯২৪ সালে উত্তর চীনে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি উত্তর চীন অভিযানের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময় সমরনায়ক ফেং-ইউ-সিয়াং-এর সামরিক উত্থানের জন্য গৃহযুদ্ধ বন্ধ হয়েছিল। ফেং পিকিং দখল করেছিলেন এবং চীনে জাতীয় ঐক্যকে আনার জন্য একটি সম্মেলনে সানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এই সম্মেলনে সান যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু এই সম্মেলন চলা কালে তিনি অসুস্থ হয়ে ১৯২৫ সালের ১২ই মার্চ মৃত্যুবরণ করেছিলেন। সহকর্মীদের প্রতি তার শেষ বাণী ছিল “বিপ্লব এখনও অসম্পূর্ণ। অতএর বন্ধুগণ, প্রচেষ্টা চালিয়ে যাও।"
KMT দলের প্রাণপুরুষের মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে এই দলকে বিচলিত করেছিল। তার মৃত্যুর পর এই দলের দায়িত্বভার অর্পিত হয়েছিল ওয়াং চিং উই এবং ছ-হ্যান মিন-এর ওপর। এরা ছিলেন KMT দলের বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থী নেতৃত্বদানকারী নৈতা। সামরিক ক্ষমতা থাকে চিয়াং-কাই-শেকের হাতে। সানের যে বিচক্ষণতা ছিল এই নেতাদের তা ছিল না। স্বাভাবিকভাবে পরবর্তীকালে দেখা যায় KMT-র সঙ্গে CCP-র বিরোধ। এই বিরোধ চীনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছিল। KMT দল CCP-র কাছে গৃহযুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল। ১৯৪৯ সালে মাও-সে তুঙের নেতৃত্বে চীনে সাম্যবাদী শাসন শুরু হয়েছিল।
KMT দলের নেতা সান-ইয়াৎ সেন যে একজন অসাধারণ ব্যক্তি ছিলেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। চীনের জাতীয়তাবাদের তিনি ছিলেন জনক। তাঁর চেষ্টাতেই ১৯১১ সালে চীন থেকে দীর্ঘদিনের রাজতন্ত্রের অবসান হয়েছিল এবং চীনে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি হিসাবে তিনি কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু বিপ্লবী নেতা হিসাবে তিনি যতটা সফল ছিলেন প্রশাসক হিসাবে তিনি তা ছিলেন না। ইউয়ান-সি-কাই-এর মতো স্বার্থপর সমরশাসককে তিনি বিশ্বাস করে রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি তার হাতে প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বভার তুলে দিয়ে চীনকে ঘোর অনিশ্চয়তার অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছিলেন। নিজের হাতে বসানো শাসককে উৎখাত করার জন্য তাকে আবার বিপ্লবের ডাক দিতে হয়েছিল। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। জাপানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। KMT দলকে তিনি পুনরায় সংগঠিত করেছিলেন। ১৯১৯ সালের পর তার নেতৃত্বে KMT দল শক্তিশালী হয়েছিল। কিন্তু নিরপেক্ষভাবে বিচার করলে দেখা যাবে যে তিনি আবার রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে মিত্রতা করতে গিয়ে তিনি নিজের বিপদ ডেকে এনেছিলেন। সোভিয়েত রাশিয়া বলশেভিক বিপ্লবকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সচেষ্ট ছিল। চীনের নেতা সান কমিউনিস্টদের সেই সুযোগ এনে দিয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের চীনের প্রতি আচরণ সানকে বিরক্ত করেছিল। তিনি ১৯২৩ সালের জুলাই মাসে The New York Times পত্রিকায় ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলেন পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের প্রতি তার সব মোহ নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি সোভিয়েত রাশিয়া ছাড়া অন্য কোনো দেশকে বিশ্বাস করেন না।
সোভিয়েত রাশিয়া নিজের স্বার্থে চীনকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল। লেনিনের বক্তব্য ছিল এশিয়া থেকে উপনিবেশবাদের অবসান না হলে ধনতন্ত্রের পতন হবে না। ধনতন্ত্রের ধ্বংসসাধন করতে হলে এশিয়া থেকে উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটাতে হবে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে। এই আন্দোলনকে সাহায্য করা দরকার। সোভিয়েত সাহায্যে আন্দোলন তীব্র হলে এশিয়া থেকে উপনিবেশবাদের অবসান হবে। বিদেশি বিরোধী এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে বুর্জোয়া বা আধা-বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলি। যেমন চীনে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে KMT দল এবং ভারতে জাতীয় কংগ্রেস। লেনিন এই দুই দলকে সাহায্যের কথা বলেছিলেন। এই নিয়ে রায় লেনিন বিতর্ক হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত লেনিনের বক্তব্যকে মেনে নিয়ে ঠিক হয় যে চীন সহ বিভিন্ন এশীয় দেশে বুর্জোয়া দলগুলোকে সাহায্য করা হবে। এর ফলে সোভিয়েত রাশিয়া চীনকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল। ডাঃ সান সোভিয়েত রাশিয়ার উদ্দেশ্যকে বুঝতে না পেরে তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলেন। তিনি কমিউনিস্টদের নিজের দলে স্থান দিয়েছিলেন। তাঁর এই সিদ্ধান্ত বুমেরাং হয়েছিল পরবর্তীকালে। দুই বিপরীতমুখী আদর্শগত দলের এই সমন্বয় ছিল ক্ষণিকের। তিনি যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন KMT ও CCP-র মধ্যে সংঘাত হয়নি সত্য কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর এই সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়েছিল।
*****টোকুগাওয়া শোগুনতন্ত্রের পতনের কারণ/ what was the main downfall of the tokugawa shogunate.
0 Comments
If you like the posts, you must comment. and if there is any problem , please let me know in the comments.