পাবনার কৃষক বিদ্রোহ | পাবনা বিদ্রোহ কেন হয়েছিল ? | পাবনা বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য | পাবনা কৃষক বিদ্রোহের ফলাফল | পাবনা বিদ্রোহ কোথায় হয়েছিল? |পাবনা বিদ্রোহের প্রকৃতি বিশ্লেষণ কর ।|পাবনা কৃষক বিদ্রোহ সম্পর্কে আলোচনা |
পাবনার কৃষক বিদ্রোহ প্রসঙ্গে ডঃ কল্যাণ কুমার সেনগুপ্ত তাঁর গবেষণামূলক গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন "The uprising in 1873 of ryots of Pabna against the permanently settled landlords is a significant event in the late 19th century socio-economic history of Bengal.' তাঁর এই মন্তব্য সম্পর্কে দ্বিমতের অবকাশ নেই। কিন্তু পাবনার কৃষক বিদ্রোহের কারণ, চরিত্র, প্রকৃতি প্রভৃতি প্রশ্নকে কেন্দ্র করে ঐতিহাসিকদের মধ্যে তীব্র মতভেদ আছে। তবে পাবনা বিদ্রোহ যে জমিদার বিরোধী এবং এই বিদ্রোহ যে মূলতঃ সম্পন্ন ও বর্ধিষ্ণু কৃষক বা জোতদার শ্রেণীর বিদ্রোহ, তা নিয়ে মধ্যে কোন বিরোধ নেই।
পাবনার কৃষক বিদ্রোহের কারণ :
পাবনা বিদ্রোহের কারণ ব্যাখা করতে গিয়ে অধিকাংশ ঐতিহাসিকই জমিদার শ্রেণীর শোষণ ও অত্যাচারের কথা উল্লেখ করেছেন। এই শোষণ ও অত্যাচারের সবচেয়ে বড় প্রমাণ হ'লো যথেচ্ছ করবৃদ্ধি। অধ্যাপক সুনীল সেন বলেছেন “খাজনার প্রশ্ন নিয়ে কিভাবে জমিদার ও প্রজার মধ্যে তিক্ত সম্পর্ক সৃষ্টি করেছিল।
তা পাবনা বিদ্রোহের মধ্যে প্রতিফলিত হ'য়েছে।” বস্তুতঃ খাজনা বৃদ্ধির হার ছিল। অত্যধিক। ১৭৯৩ থেকে ১৮৭২ সালের মধ্যে করের বোঝা বেড়েছিল সাতগুণ। ৮২ ১৮৫৯ সালের দশম আইনকে অগ্রাহ্য করে জমিদারেরা কৃষকদের কাছ থেকে বর্ধিত হারে কর আদায় করতো। এই করবৃদ্ধির হার অবশ্য কোন অঞ্চলে কত ছিল, তা অনেকাংশে অজ্ঞাত। পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার ইসুফশাহী পরগণা ছিল। নাটোর রাজের অধীন। কিন্তু রাজস্ব বাকি থাকার জন্য এই জমিদারী নিলামে ওঠে এবং তা কিছু ধনী জমিদারী পরিবার কিনে নেয়। এই সব ক্রেতা জমিদারদের মধ্যে ছিল কলকাতার ঠাকুর পরিবার, ঢাকার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার, সলপের সান্যাল পরিবার, পোরজনার ভাদুড়ী পরিবার ও স্থলের পাকড়াশি পরিবার। এই জমিদারদের মধ্যে ঠাকুর পরিবারের জমিদারের বিজেন্দ্রলাল ঠাকুর তাঁর জমিদারীর খাজনা শতকরা পঞ্চাশ ভাগ বাড়িয়েছিলেন বলে জানা যায়। ১৮৫৯ সালের আইনে করবৃদ্ধির সুযোগ কিছুটা সঙ্কুচিত হওয়ায় অনেক সময় জমিদারেরা সরাসরি খাজনার হার বৃদ্ধি না করলেও নানাভাবে অবৈধ পথে অর্থ (আবওয়াব) আদায় করতো। মূল করের সঙ্গে এই সব আবওয়াব যুক্ত হওয়ায় কৃষকদের পক্ষে এই বোঝা দুর্বহ বলে মনে হতো। এই ভাবে নানা অজুহাতে কৃষকদের কাছ থেকে যে বাড়তি অর্থ আদায় করা হতো, ডঃ কল্যাণ সেনগুপ্ত তার বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন। ৮৩ কৃষকেরা এই ধরনের আবওয়াব আদায় মোটেই পছন্দ করতো না। অনেক সময় আবওয়াবের পরিমাণ মাত্রা ছাড়িয়ে যেত। সরকারও এর বিরোধী ছিল। ১৮৭২ সালে সরকার আবওয়াব তুলে দিতে তৎপর হয়। জমিদারেরা তখন আবওয়াব থেকে যে টাকা আদায় হতো, তা মূল খাজনার সঙ্গে জুড়ে দেয় এবং এর জন্য তারা প্রজাদের কাছ থেকে কবুলিয়ত দাবী করে। কিন্তু বলপূর্বক কবুলিয়ত দাবী করা হলেও তার বিনিময়ে কৃষককে কোন পাট্টা দিতে তারা অস্বীকৃত হয়। আর একটি অবৈধ পথেও জমিদারেরা করবৃদ্ধি করতে তৎপর হয়। তা হলো নতুন জমি জরিপ পদ্ধতি। নতুন জমিদারেরা তাদের রায়তদের জমি এমন অবৈধপথে জরিপ করে যে, তার ফলে কৃষকদের জমির পরিমাণ হ্রাস পায়। তখন সেই বাড়তি জমি অপর কৃষকদের কাছে নতুনভাবে পত্তনি দেওয়া হয় এবং তা থেকেও খাজনা আদায় করা হয়। সরকারী ও বেসরকারী উভয় সূত্র থেকেই আমরা জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষকদের ব্যাপক ক্ষোভ ও অসন্তোষের কথা জানতে পারি। সিরাজগঞ্জের মহকুমা শাসক এস.ডি.এ. নোলান (Nolon) ও পাবনার জেলা শাসক টেলার উভয়েই মনে করেন যে, অত্যধিক করবৃদ্ধিই পাবনা বিদ্রোহের জন্য দায়ী। সোমপ্রকাশ, সুলভ সমাচার, Friend of India প্রভৃতি সমকালীন পত্র পত্রিকাতেও বলা হয়েছিল যে, করবৃদ্ধির জন্যই পাবনার কৃষকেরা বিদ্রোহ করেছিল। সোমপ্রকাশ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল “বর্তমান সময়ে যে রূপ দেখা যাইতেছে প্রজারই সমূহ কষ্ট। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা জমিদারের দেয় কর চিরদিনের জন্য নির্ধারিত হইয়াছে। কিন্তু প্রজাদিগের দেয় করের সীমা নাই।” ডঃ চিত্তব্রত পালিতের মতে এই করবৃদ্ধি অস্বাভাবিক ছিল না। কিছুটা নিরুপায় হয়ে জমিদারেরা করবৃদ্ধির পথ বেছে নিয়েছিল। তাঁর বক্তব্য হলো সিরাজগঞ্জ, রাজসাহী, ঢাকা ও ফরিদপুর জেলার অর্ধেক জমিদারই ঋণগ্রস্ত হ'য়ে পড়েছিল। ১৫ অন্যদিকে সম্পন্ন কৃষক বা জোতদারদের স্বচ্ছলতা দিন দিন বেড়ে চলেছিল। বাণিজ্যিক ফসলের উৎপাদন ছিল তাদের স্বচ্ছলতার মূল কারণ। যাই হোক ডঃ পালিত অবশ্য স্বীকার করেন যে, অত্যধিক করবৃদ্ধিই ছিল পাবনা বিদ্রোহের প্রধান কারণ।
পাবনা বিদ্রোহ কবে কোথায় হয় ?
পাবনা কৃষক বিদ্রোহ (১৮৭৩-৭৬) ছিল পাবনার ইউসুফশাহী পরগনায় হয় ।
ডঃ কল্যাণ কুমার সেনগুপ্ত কিন্তু করবৃদ্ধিকেই পাবনা বিদ্রোহের প্রধান বা একমাত্র কারণ বলে মনে করেন না। তিনি এই বিদ্রোহের কারণ ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে। তাঁর মতে এই বিদ্রোহের প্রধান কারণ হলো জমিদার কর্তৃক রায়তদের নবলব্ধ অধিকার অস্বীকার ও অগ্রাহ্য করা। তিনি লিখেছেন "The agrarian unrest in eastern and central Bengal in the late 19th century was caused not so much by the enhancement of rent by the zamindars of eastern Bengal as by the persistent attempts of the latter to do away with the rights of occupancy of a new class of ryots, the occupaney tenants. ১৮৫৯ সালের দশম আইন জমিদারেরা মেনে নিতে পারে নি। এই আইনে কৃষকেরা যে সব সুযোগ সুবিধা ও অধিকার পেয়েছিল, জমিদারেরা তা থেকে তাদের বঞ্চিত করতে চেয়েছিল। অন্যদিকে কৃষকরাও তাদের অধিকার সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিল। সুতরাং তারা জমিদারদের এই প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে বদ্ধপরিকর ছিল। এই অবস্থাই বিদ্রোহের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। ডঃ সেনগুপ্ত বলতে চেয়েছেন যে, ১৮৫৮ থেকে ১৮৭৩ পর্যন্ত প্রজারা জমিদারদের খাজনা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা কোন বড় ধরনের প্রতিবাদ ছাড়াই মেনে নিয়েছিল। তারা আশা করেছিল। যে, ভবিষ্যতে এই ধরনের করবৃদ্ধি আর হবে না। আসলে তারা চাইছিল একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দেয় করের স্থিতিশীলতা। কিন্তু জমিদারেরা যেভাবে এবং যখন তখন কর বৃদ্ধি করছিল, তাতে তাদের আপত্তি ছিল। সুতরাং কৃষকেরা শুধু করবৃদ্ধির বিরুদ্ধেই নয়, তারা সমস্ত প্রকার জমিদারী অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। তাদের বিদ্রোহ করতে সাহস যুগিয়েছিল সরকারের কৃষক দরদী মনোভাব। কয়েক জন সরকারী কর্মচারী জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করায় প্রজাদের মনে আস্থার উদয় হয়েছিল। এখানে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। একজন জমিদার মামলায় হেরে যাবার পর প্রজাপক্ষের একজন সাক্ষীকে বলপূর্বক আটক করে রাখেন। কিন্তু মহকুমা শাসক পিটার নোলন তাকে উদ্ধার করতে সমর্থহন এবং এজন্য জমিদারকে শাস্তি পেতে হ'য়েছিল। সরকারের এই তৎপরতা অবশ্যই কৃষকদের মনোবল বাড়িয়েছিল।
জমিদারী শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে পাবনার কৃষকেরা যে সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, তা ভারতের কৃষক আন্দোলনে নিঃসন্দেহে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তারা কর দেয়া বন্ধ করে ও আদালতের আশ্রয় নিয়ে তাদের আন্দোলন চালিয়ে যায়। তারা একটি কৃষক সমিতি বা agrarian league গড়ে তোলে। ১৮৭৩ সালের মে মাসে এই সমিতি স্থাপিত হয় ও জুন মাসের মধ্যে ইসুফসাহী পরগণা সহ সমগ্র পাবনা জেলা জুড়ে এর শাখা-প্রশাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। মামলা মোকদ্দমার ব্যয় বহন করার জন্য এই সমিতি এক অর্থ ভাণ্ডার গড়ে তোলে এবং সমিতির সদস্যরাই শুধু নয়, যে সব প্রজা জমিদারদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ছিল, তারা সবাই এই অর্থভাণ্ডারে চাঁদা দিত। জমিদার বা তার কোন কর্মচারী অবৈধভাবে কোন অর্থ দাবী করতে এলে গ্রামের লোককে সচেতন করার জন্য ও তারা যাতে সবাই এক জায়গায় জমায়েত হয়, তার জন্য মোষের শিং-এর শিঙা বাজিয়ে দেওয়া হত। কখনও কখনও বা ঢাক ঢোলও বাজানো হত। যে সব গ্রাম বিদ্রোহে অংশ গ্রহণ করতো না, সেখানে প্রচারক পাঠিয়ে দেওয়া হত। অনেক সময় অনিচ্ছুক কৃষককে বিদ্রোহে অংশ গ্রহণ করতে বাধ্য করা হতো। এক কথায় বলা যায় বিদ্রোহীদের সংগঠন ছিল খুব জোরালো ও মজবু।
পাবনার কৃষক বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন :
বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিল সম্পন্ন কৃষক বা জোতদার শ্রেণী। নেতাদের মধ্যে দৌলতপুরের ক্ষুদ্র ভূস্বামী ও ব্যবসাদার ঈষাণচন্দ্র রায়, মেঘুল্লা গ্রামের মোড়ল শম্ভুনাথ পাল ও জোগতোল্লার জোতদার খুদি মোল্লার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঈষাণচন্দ্র বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন। জনপ্রিয় এই নেতাকে কৃষকেরা 'বিদ্রোহী রাজা' বলে ডাকতো। শম্ভুনাথ পাল ছিলেন তাঁর সহকারী। সাধারণভাবে গ্রাম প্রধানের কাজ ছিল রায়তদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা ও গ্রামস্তরে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দান করা। জমিদারের লাঠিয়ালের বিরুদ্ধে তারাই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিত। লক্ষ্য করার বিষয় এই বিদ্রোহে ধনী কৃষক বা জোতদার শ্রেণীর ভূমিকা প্রধান হলেও অস্থায়ী কৃষক (tenants at will), ভাগচাষী ও বিভিন্ন কৃষি ধার্মিকও, যারা ব্যাবৃদ্ধির ফলে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি, এই বিদ্রোহে সামিল হ'রোছিল। জমিদারদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ ও অসন্তোষই তাদের এই বিদ্রোহে উৎসাহিত করেছিল। অধ্যাপক চিত্তব্রত পালিত মনে করেন যে, মাঝারি ও ছোট চাষীরা এই বিদ্রোহে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগদান করলেও, কারণ অত্যধিক করবৃদ্ধি জোতদারদের মত তাদেরও মনঃপূত ছিল না, বর্গাদার বা আধিয়াররা, যারা ভাগে জমি চাষ করতো, সম্ভবতঃ স্বতস্ফূর্তভাবে এই বিদ্রোহে যোগদান করেনি। ৮৭ শোষক হিসাবে জমিদার ও জোতদারদের মধ্যে খুব একটা তফাৎ তাদের কাছে ছিল না বলে মনে হয়। খুব সম্ভব বুঝিয়ে সুঝিয়ে বা প্রচারকার্যের মাধ্যমে তাদের এই বিদ্রোহে অংশ গ্রহণ করতে প্রণোদিত করা হয়েছিসঞ্চার করেছিল। অনেক জমিদারই ভয়ে সপরিবারে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে শহরে আশ্রয় নেয়। ডঃ কল্যাণ কুমার সেনগুপ্ত এই ধরনের ব্যাখ্যার বিরোধিতা করে বলেছেন।
পাবনার কৃষক বিদ্রোহ প্রকৃতি:
"This agrarian movement in the district of Pabna rarely degenerated into a jaquerie. তিনি মন্তব্য করেছেন যে, জমিদার শ্রেণীর সমর্থক সমকালীন পত্র পত্রিকার অতিরঞ্জিত বিবরণ থেকে বিদ্রোহকে আপাতদৃষ্টিতে হিংসাত্মক বলে মনে করা স্বাভাবিক। অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে এই ধরনের একটা ধারণা সৃষ্টি করা হয়ে ছিল যে, এই আন্দোলনে আসলে কোন কৃষক বিদ্রোহ ছিল না; কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি কৃষকদের উত্তেজিত করে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়েছিল। দ্বিজেন্দ্রলাল ঠাকুর পাবনার প্রজাদের হিংসাশ্রয়ী কার্যকলাপের বিবরণ বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের কর্ণগোচর করেছিলেন। মোক্তাররাও জমিদারের সুরে সুর মিলিয়েছিল। সমকালীন পত্র পত্রিকায় (হিন্দু পেট্রিয়ট, অমৃতবাজার পত্রিকা ইত্যাদি) জমিদার ও মোক্তারদের এই ধরনের প্রচার যে অনেকাংশে ভিত্তিহীন, তা পরে সরকারীভাবে স্বীকৃত হ'য়েছিল। আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত কৃষকদের বিচার থেকে তা প্রমাণিত হয়। অনেকের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন। হয়েছিল। আবার অনেককেই খুব লঘু শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। সমকালীন কিছু সংবাদপত্রেও (যেমন বেঙ্গলী, ফ্রেণ্ড অব ইণ্ডিয়া ইত্যাদি) বলা হয়েছিল যে, কৃষকদের অত্যাচারের কাহিনী বাড়িয়ে লেখা হয়েছিল। এই সব যুক্তি তর্কের উপর নির্ভর করে ডঃ সেনগুপ্ত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হ'য়েছিল যে, পাবনা বিদ্রোহে হিংসাশ্রয়ী ঘটনার সংখ্যা ছিল নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। বিদ্রোহীরা কখনই আইন নিজেদের হাতে তুলে নেয় নি, বরং তারা সব সময়েই চেষ্টা করতো আইনের সীমারেখা অতিক্রম না করতে। অবশ্য কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বার্থের সংঘাতের জন্য হিংসাশ্রয়ী কিছু ঘটনা ঘটেছিল। আবার অনেক সময় দুষ্কৃতকারীরা বিদ্রোহের সুযোগ নিয়ে গণ্ডগোল করেছে। কিন্তু এই ধরনের ঘটনার সঙ্গে বিদ্রোহের মূল বিষয়ের কোন প্রত্যক্ষ যোগ ছিল না। আসলে পাবনা বিদ্রোহ হিংসার পথে নয়, আইনের পথ ধরেই সংগঠিত হয়েছিল বলে ডঃ সেনগুপ্ত তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেছে।
পাবনা বিদ্রোহ যে জমিদার বিরোধী ছিল, সে কথা আগে বলেছি। কিন্তু এই বিদ্রোহে জমিদারদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও দু-চার কথা বলা প্রয়োজন। কৃষক সমিতি গঠিত হবার পর জমিদারেরা প্রথমে ঘটনার গতিবিধি লক্ষ্য করতে থাকে এবং এ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় নি। তাদের ধারণা হ'য়েছিল উত্তেজনা আস্তে আস্তে থিতিয়ে আসবে এবং আদালতে প্রজাদের হার হবে। তাদের এই ধারণা অবশ্য শেষ পর্যন্ত ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছিল। এই অবস্থায় জমিদারেরা আদালতে প্রজাদের নানাভাবে হেনস্থা করতে থাকে। স্থায়ী রায়তদের শায়েস্তা করার জন্য তারা অস্থায়ী রায়তদের পাট্টা দিতে থাকে। জমিদার শ্রেণীর সংগঠন ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া এ্যাসোসিয়েশন স্বাভাবিকভাবেই জমিদার শ্রেণীকে সমর্থন করে। হিন্দু পেট্রিয়ট ও অমৃতবাজার পত্রিকায় জমিদারদের পক্ষে রচনা প্রকাশ করা হয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটা অংশ অবশ্য কৃষকদের পক্ষে ছিল। রমেশচন্দ্র দত্ত পাবনার কৃষকদের সমর্থন করেন। পরের দিকে ইণ্ডিয়ান এ্যাসোসিয়েশনও কৃষকদের ন্যায্য পাওনা সমর্থন করেছিল। অন্যদিকে সরকার প্রথমদিকে কিছুটা কৃষকদরদী ও জমিদারবিরোধী মনোভাবের পরিচয় দিলেও শেষ পর্যন্ত জমিদারদের রক্ষা করার জন্যই সামরিক ও পুলিশি ব্যবস্থা গ্রহণ করে। জমিদারদের পক্ষে এই সরকারী তৎপরতার ফলে বিদ্রোহ ক্রমশঃ তার গতি হারিয়ে ফেলতে থাকে এবং ঈষাণ চন্দ্র রায়সহ বহু কৃষক নেতা ধরা পড়ে। ঈষাণ চন্দ্র রায়কে অবশ্য পরে মুক্তি দেওয়া হয়।পাবনা বিদ্রোহ সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয় নি। এই বিদ্রোহের ফলে জমিদার ও কৃষকদের সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয় এবং সরকার উপলব্ধি করেন যে, প্রজাদের স্বার্থে আইন তৈরী করা প্রয়োজন। এই পরিস্থিতি ১৮৮৫ সালের প্রজাস্বত্ব আইনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এই বিদ্রোহ জমিদারবিরোধী হলেও কখনই প্রত্যক্ষভাবে সরকার বিরোধী ছিল না। আসলে বিদ্রোহীদের লক্ষ্য ছিল অত্যন্ত সীমিত। তাদের কর বয়কট আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল অবৈধ জরিপ ব্যবস্থার বদল, আবওয়াব বা অবৈধ করের বিলোপ, করের পরিমাণ হ্রাস ইত্যাদি। এই বিদ্রোহ কখনই ব্রিটিশ বিরোধী ছিল না বা আদিবাসী কৃষকেরা যেমন পুরোপুরি কর ব্যবস্থার উচ্ছেদ চেয়েছিল, তারা তা চায় নি। তারা জমিদারদের কর দিতে না চাইলেও মহারাণীকে কর দিতে কখনই আপত্তি করে নি। পাবনা বিদ্রোহের চরিত্র বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে আর একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন। অস্থায়ী চাষী, ভাগচাষী বা অন্যান্য ছোট চাষী এই বিদ্রোহে অংশ নিলেও এর ফলে তাদের কোন উপকার হয় নি। জোতদার শ্রেণীভুক্ত সম্পন্ন কৃষক ও তাদের স্বার্থ অবশ্যই এক ছিল না। বরং অনেক সময়েই তারা তাদের অধীনস্থ অস্থায়ী চাষী ও ভাগচাষীদের কাছ থেকে নানাভাবে অবৈধ অর্থ আদায় করতো। সুতরাং গ্রামীণ সমাজে শ্রেণী সংঘাত ও সংঘর্ষ এই উত্তেজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে থাকে। অধ্যাপক পালিতের মতে বিংশ শতকের কৃষি সম্পর্কের জটিলতার উৎস নিহিত আছে ঊনিশ শতকের শেষ পর্বে। তাঁর কথা উদ্ধৃত করে বলি- "It will be unhistorical to say that only in the 20th century, these well to-do peasants as jotedars themselves became the exploiters of the share croppers known in Bengal as adhiars and bargadars."
পাবনার কৃষক বিদ্রোহ কি সাম্প্রদায়িক ছিল :
পাবনা বিদ্রোহ কি সাম্প্রদায়িক ছিল? এটি আর একটি বিতর্কিত প্রশ্ন। অনেকেই এই বিদ্রোহকে বিশ্লেষণ করেছেন সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণে। তাদের বক্তব্যের সারাংশ হলো এই যে, কৃষক সমিতির অধিকাংশ সদস্যই ছিল মুসলমান এবং ধৃত অপরাধীদের দুই তৃতীয়াংশ ছিল মুসলমান। অন্যদিকে জমিদারেরা ছিল হিন্দু। সুতরাং পাবনা বিদ্রোহ ছিল হিন্দু-মুসলমানের লড়াই। হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকা সরকার ও জনগণকে বোঝাতে চেয়েছিল যে, ১৮৭৩ সালের বিদ্রোহ কোন কৃষক বিদ্রোহ নয়। আসলে মুসলমান প্রজারা হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে সমবেত হয়েছিল। হালিশহর পত্রিকা আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছিল যে, এই বিদ্রোহে সরকার মুসলমানদের তোয়াজ করেছিল। সোমপ্রকাশ পত্রিকাতেও বিদ্রোহের সাম্প্রদায়িক চরিত্রের উপর জোর দেওয়া হয়েছিল। ডঃ কল্যাণ কুমার সেনগুপ্ত পাবনা বিদ্রোহের সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যার সমালোচনা করে বলেছেন যে, এই বিদ্রোহের নেতা ছিলেন দুজন হিন্দু — ঈষাণ চন্দ্র রায় ও শম্ভুনাথ পাল। হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কোন আন্দোলন হলে এঁরা নিশ্চয়ই তার সঙ্গে নিজেদের জড়াতেন না। আসলে পাবনা বিদ্রোহের মূল বিষয়ই ছিল জমিদার ও কৃষকদের মধ্যে শ্রেণী সংঘর্ষ এবং এই সংগ্রাম ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে নি। কৃষক সমিতির সংগঠন ও তার কার্যাবলী প্রমাণ করে যে, ধর্মের কোন ভূমিকা সেখানে ছিল না। বিদ্রোহীরা কখনও হিন্দুধর্মের উপর আক্রমণ করে নি। কোন মন্দির ধ্বংস করা হয় নি বা কাউকে জোর করে মুসলিম ধর্মে দীক্ষিত করা হয়নি। তবে পাবনা বিদ্রোহের ধর্ম নিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে ডঃ সেনগুপ্ত এমন কিছু যুক্তির অবতারণা করেছেন, যা মেনে নেওয়া কঠিন এবং সঙ্গত কারণেই রণজিৎ গুহ তাঁর সমালোচনা করেছেন। ডঃ সেনগুপ্ত মন্তব্য করেছেন যে, প্রজাদের অধিকাংশই ছিল ধর্মান্তরিত মুসলমান এবং এদের অনেকেই মুসলিম ধর্ম ও কোরাণের আদর্শ সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অজ্ঞ ছিল। ধর্মান্তরিত মুসলমান বলেই যে হিন্দু জমিদারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে না, বা কোরাণ সম্পর্কে অজ্ঞ বলেই যে কোন ধর্মীয় উন্মাদনা থাকবে না, এমন কোন কথা নেই। আবার পাবনা বিদ্রোহে ধর্মের কোন ভূমিকাই ছিল না বললে তা ভুল করা হবে। ঊনিশ শতকে বাংলার কৃষকেরা ধর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল না। কৃষকদের মধ্যে চেতনা সঞ্চারে ধর্ম ছিল একটি অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম। পাবনা বিদ্রোহের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ডঃ সেনগুপ্ত দেখিয়েছেন কিভাবে মুসলিম ধর্ম পাবনার কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করতে সহায়ক হয়েছিল। বিশেষতঃ ফরাজী মতাদর্শ মুসলিম কৃষকদের দিয়েছিল এক সর্বাত্মক ঐক্যের প্রেরণা।
পাবনার কৃষক বিদ্রোহর উপসংহার :
জমিদারী শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ হিসাবে পাবনা বিদ্রোহ বাংলার কৃষকদের সংগ্রামী ঐতিহ্যের সাক্ষ্য দেয়। এর ফলে জমিদারী শোষণ ও অত্যাচারের অবসান না হলেও বা সাধারণ কৃষক এর দ্বারা উপকৃত না হলেও এই বিদ্রোহ তখন বাংলার গ্রামজীবনে এক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। বিভিন্ন ছড়ায় ও গানে এই বিদ্রোহের কাহিনী অমর হয়ে আছে। কৃষক সমিতির মাধ্যমে যেভাবে সংগঠিত পথে বাংলার কৃষকেরা লড়াই করেছিল, তা এক অভিনব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। সুপ্রকাশ রায় মন্তব্য করেছেন “ইহা (কৃষক সমিতি) যেন পরবর্তী কালের নিখিল ভারত কৃষক সভারই অগ্রদূত স্বরূপ।”৯২ পাবনা বিদ্রোহের প্রভাব শুধু পাবনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলনা। এই বিদ্রোহ অন্যান্য অঞ্চলের কৃষকদেরও অনুপ্রাণিত করেছিল। পার্শ্ববর্তী জেলা বগুড়াতে এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছিল। বস্তুতঃ ১৮৭৩ থেকে ১৮৮৩ সালে মধ্য ও পূর্ব বিভিন্ন জেলায়, যেমন ঢাকা, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা, বগুড়া, বাখরগঞ্জ এবং রাজসাহীতে কৃষকেরা জমিদারের অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। বিভিন্ন স্থানে কৃষক সভা স্থাপিত হয়েছিল। বিদ্রোহের প্রকোপ, ব্যাপকতা ও সাফল্য অবশ্য সব জায়গায় সমান ছিল না। নবাগত ও অপরিচিত জমিদারের ক্ষেত্রে প্রজা প্রতিরোধ আরও তীব্র ও ব্যাপক ছিল। অনেক জমিদারী নীলামে ওঠায় কলকাতায় কিছু সম্পন্ন মানুষ এই সব জমিদারী কিনে নিয়েছিল। আগেকার প্রাচীন জমিদারী পরিবার প্রজাদের যে স্বাভাবিক আনুগত্য লাভ করতো, এই সব বহিরাগত জমিদারদের ক্ষেত্রে তা একান্তরূপে অনুপস্থিত ছিল। একই ভাবে প্রজা প্রতিরোধ সেই সব অঞ্চলে ছিল অধিকতর জোরদার ও কার্যকরী, সেখানকার কৃষকেরা নিজেদের আইনসঙ্গত ক্ষমতা ও অধিকার সম্পর্কে অধিকতর সচেতন ছিল। যাই হোক এইসব বিদ্রোহের অনুপ্রেরণার উৎস হিসাবে পাবনা বিদ্রোহের গুরুত্বপূর্ণ অবদান স্বীকার করতে হবে।
0 Comments
If you like the posts, you must comment. and if there is any problem , please let me know in the comments.