মেইজি রেস্টোরেশন পটভূমি / মেইজি রেস্টোরেশন প্রকৃতি/ Meiji Restoration significance / Meiji Restoration in Bengali/

মেইজি রেস্টোরেশন পটভূমি / মেইজি রেস্টোরেশন প্রকৃতি/ Meiji Restoration significance / Meiji Restoration in Bengali : 

মেইজি রেস্টোরেশন পটভূমি / মেইজি রেস্টোরেশন প্রকৃতি/ Meiji Restoration significance / Meiji Restoration in Bengali/


আগের অধ্যায়ে আমরা বলেছি চীনের মতো দ্বীপময় সাম্রাজ্য জাপান দীর্ঘদিন বাইরের জগৎ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। নাগাসাকির কাছে ডেশিমা দ্বীপে ওলন্দাজ বণিকেরা কিছুটা বাণিজ্যের সুযোগ পেয়েছিল। জাপানের ইতিহাসে এই পর্ব ‘সাকোকু জিদাই' বা Closed Country নামে পরিচিত। বিদেশিরা জাপানে প্রবেশের কোনো অনুমতি পেত না। জাপানিরাও বিদেশে যেত না। শোগুনতন্ত্র বড়ো জাহাজ নির্মাণেরও অধিকার দেয়নি। জাপানিরা ওলন্দাজ বণিকদের কাছ থেকে এশিয়ার অন্যান্য দেশে বিদেশি বণিকদের সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপ সম্পর্কে অবগত হয়েছিল। বণিকের মানদণ্ড যাতে জাপানে রাজদণ্ডে পরিণত হতে না পারে, সেজন্য জাপানের টোকুগাওয়া শাসকেরা বিদেশিদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল।


কিন্তু বিদেশিরা বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানি শাসকদের বাধা-নিষেধকে অতিক্রম করতে বদ্ধপরিকর হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় তাদের বাণিজ্যের বিস্তার ঘটাতে চেয়েছিল। বহু মার্কিন তিমি শিকারি জাপান উপকূলে তিমি শিকারে আসত। প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের জাহাজ বিধ্বস্ত হলে তারা জাপানের উপকূলে আশ্রয় নিত। কিন্তু জাপানিরা তাদের ওপরে অত্যাচার করত। কয়লা ও প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য মার্কিনিরা পেত না। এইসব অসুবিধাগুলিকে দূর করার জন্য মার্কিন নাবিক ও বণিকরা মার্কিনি সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল। মার্কিন সরকার জাপানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য কমোডর পেরি নামক এক নৌ সেনাপতিকে জাপানে পাঠিয়েছিল। রিচার্ড স্টোরি কমোডর পেরির অভিযানের পিছনে চারটি কারণকে ব্যাখ্যা করেছেন। সেগুলি হল : (১) ক্যান্টন বন্দরের মাধ্যমে চীনের সঙ্গে মার্কিন বাণিজ্যের বিকাশ। (২) প্রশান্ত মহাসাগরে তিমি মাছ শিল্পের বিকাশ। (৩) ক্যালিফোর্নিয়ার উন্মুক্তি এবং ১৮৪৯ সালের স্বর্ণপ্রবাহের আবিষ্কার তাদের নতুন স্থান সন্ধানের আকাঙ্ক্ষাকে বাড়িয়েছিল। (৪) বাষ্পচালিত নৌবহরের প্রাধান্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে জাপানকে উন্মুক্ত করার জন্য আকৃষ্ট করেছিল। কমোডর পেরি মার্কিন রাষ্ট্রপতির চিঠিসহ যুদ্ধজাহাজ নিয়ে জাপানে এসেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল।


কমোডর পেরি যখন জাপানের বদ্ধ দরজাকে উন্মুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন, তখনকার জাপানের সামাজিক, রাজনৈতিক ও আর্থিক চিত্র সম্পর্কে কিছু ধারণা চীন ও জাপান (চট্টো.)-২৪

থাকা প্রয়োজন। জাপানের সম্রাট দেবতার অংশ হিসাবে জনগণের শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, জাপানি সম্রাটের হাতে প্রকৃত ক্ষমতা ছিল না। সব ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল শোগুনের হাতে। টোকুগাওয়া গোষ্ঠী দীর্ঘদিন শোগুনপদকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। প্রশাসনের সমস্ত ক্ষমতার আধার ছিল শোগুন। জাপানের শোগুনতন্ত্রের সঙ্গে ভারতের ইতিহাসে মারাঠাদের শাসনের অনেক মিল আছে। মারাঠা ছত্রপতি নামমাত্র শাসক ছিলেন, প্রকৃত শাসক ছিলেন পেশোয়া। একই রকমভাবে মেটারনিক ও বিসমার্কের কথাও বলা যায়। অস্ট্রিয়ার সম্রাট এবং প্রাশিয়ার সম্রাট নামমাত্র শাসক ছিলেন। প্রকৃত শাসক ছিলেন অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী মেটারনিক ও প্রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বিসমার্ক।


জাপানের সমাজ ছিল সামন্ততান্ত্রিক। চীনের মতো জাপানের সমাজ চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। সমাজের শীর্ষে ছিল সামুরাই বা যোদ্ধা শ্রেণী। দ্বিতীয় শ্রেণীতে ছিল কৃষক, তৃতীয় শ্রেণীতে শ্রমিক এবং নিম্নে ছিল বণিক শ্রেণী। (পূর্বে বিশদে


এগুলির আলোচনা আছে)।


টোকুগাওয়া শোগুনদের দক্ষ পরিচালনায় জাপানে মোটামুটি দীর্ঘদিন শান্তি বজায় ছিল। উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত জাপানে কোনো বিদেশিদের আক্রমণ হয়নি। । এই অবিচ্ছিন্ন শাস্তির পরিবেশে জাপানে সমৃদ্ধি এসেছিল। সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও জাপান শীর্ষে উঠেছিল। ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেড়েছিল। বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। বণিকদের হাতে প্রচুর অর্থ এসেছিল। জাপানের সমাজে বণিকদের কোনো মর্যাদা ছিল না। প্রচুর অর্থের মালিক হয়ে বণিকরা সামাজিক মর্যাদার জন্য উদগ্রীব হয়েছিল। ঐতিহ্যগত জাপানি সমাজের পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল।


নানা কারণে জাপানের আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়েছিল। জাপানের অর্থনীতি ছিল কৃষিভিত্তিক। প্রকৃতির করুণার ওপর এই কৃষি নির্ভরশীল ছিল। কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তির বিকাশ হয়নি। জলসেচের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। কৃষিতে সংকট এসেছিল। কৃষি থেকে ডাইমোদের তেমন আয় হচ্ছিল না। ডাইমো শ্রেণী শহরে বিলাসবহুল জীবনযাপন করত। এই শ্রেণী তাদের চাহিদা পূরণের তাগিদে কৃষকদের ওপর অতিরিক্ত কর চাপিয়েছিল। করভারে জর্জরিত জাপানের কৃষককুল বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। তাদের অসস্তোষ বিদ্রোহে পরিণত হয়েছিল। কৃষক বিদ্রোহ জাপানের প্রচলিত রাষ্ট্রবিন্যাসের ওপর আঘাত হেনেছিল।


জাপানের সমাজব্যবস্থায় সামুরাই শ্রেণী বা যোদ্ধা শ্রেণীর গুরুত্ব ছিল অনেক। বেশি। দীর্ঘদিন দেশে শান্তি বজায় ছিল বলে সামুরাই শ্রেণীকে কোনো যুদ্ধে অংশ নিতে হয়নি। তাদের শ্রম শিক্ষারও প্রয়োজন হয়নি। এই অবসরে সামুরাই শ্রেণী।

সংস্কৃতিচর্চার দিকে মন দিয়েছিল। তারা কোজিকি (Kojiki) এবং নিহোনজি (Nihonji) নামক জাপানের পুরোনো ইতিহাসকে সংকলিত করেছিল। তাদের প্রয়াসের পরিণতিতে জাপানে রেনেসাঁ শুরু হয়েছিল। সামুরাই শ্রেণী ইতিহাসের তথ্যকে সামনে রেখে এই প্রচার চালিয়েছিল যে, প্রাচীনকালে জাপানের প্রকৃত শাসক ছিল স্বয়ং সম্রাট, শোগুনরা নয়। তারা কল্পনা করেছিল প্রাচীন যুগে সম্রাটের অধীনে জাপানের মানুষ এক সুন্দর স্বর্গরাজ্যে দিনযাপন করত। তাদের প্রচারের ফলে শোগুনতন্ত্রের পতনের দিন সমাগত হয়েছিল এবং সম্রাটের ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল।


জাপানে বিদ্যাচর্চা বৃদ্ধির সাথে সাথে কিছু জ্ঞানপিপাসু ব্যক্তি ওলন্দাজদের মাধ্যমে পাশ্চাত্য দুনিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে জ্ঞাত হয়েছিল। বহু পশ্চিমি গ্রন্থ জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। পাশ্চাত্য শক্তির গুরুত্ব জাপানি মানসে ভাস্বর হয়েছিল। আলোকপ্রাপ্ত জাপানিরা জাপানের বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটিয়ে জাপানকে আধুনিক শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়েছিল। এইসব বিচক্ষণ ব্যক্তিরা সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে, পাশ্চাত্যের সমকক্ষতা অর্জন করতে হলে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষাকে জাপানে আবশ্যিক করতে হবে। এর ফলে জাপানের অভ্যন্তরে একদল আলোকপ্রাপ্ত দূরদর্শিতাসম্পন্ন মানুষ জাপানের রুদ্ধ দরজাকে পাশ্চাত্যদুনিয়ার কাছে উন্মুক্ত করার জন্য পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। তারা পশ্চিমি ইউরোপীয় শক্তিবর্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল।


এই বাতাবরণে ১৮৫৩ সালে কমোডর পেরি মার্কিন রাষ্ট্রপতি ফিলমোরের এক চিঠি দিয়ে চারটি যুদ্ধজাহাজ সহ জাপানে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। এই চিঠিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জাপানের কাছ থেকে কিছু বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা ও কয়েকটি জাপানি বন্দরে মার্কিন জাহাজ কর্তৃক কয়লা ও অন্যান্য রসদ পাওয়ার সুবিধা আদায় ও ঝড় বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কোনো মার্কিন জাহাজ বা নাবিক যদি জাপানের উপকূলে উপস্থিত হয়, তবে তারা যাতে সদয় বা ভালো ব্যবহার পায়, তার জন্য দাবি জানিয়েছিল। কমোডর পেরি এই চিঠি জাপানের কর্তৃপক্ষের হাতে দিয়ে বলেছিলেন যে, তিনি পরের বছর আরও শক্তিশালী নৌবহর নিয়ে এই চিঠির উত্তর গ্রহণ করতে আসবেন।


এই একবছর জাপানি শাসকেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে দেখেন যে, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত আমেরিকান বাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁরা কোনো সফল প্রতিরোধ গড়তে পারবেন না। সেজন্য পরের বছর কমোডর পেরি জাপানে উপস্থিত হলেজাপান তার সাথে কানাগাওয়া চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। এই চুক্তিতে জাপান তার দুটি বন্দর সীমিত বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করেছিল এবং মার্কিন নাবিকদের প্রতি সদয় ব্যবহার করতে রাজি হয়েছিল।


কানাগাওয়া চুক্তির মাধ্যমে জাপান প্রথম তার রুদ্ধ দরজাকে পাশ্চাত্য শক্তির কাছে উন্মুক্ত করেছিল। কমোডর পেরি জাপানে উপস্থিত হওয়ার আগেই সেখানকার সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার পর্যালোচনার পর দেখা গেছে যে, জাপানিদের একাংশ বিদেশিদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে রাজি ছিল। তাই একথা বলা অসঙ্গত হয় না যে, কমোডর পেরি এমন এক মুহূর্তে জাপানে এসেছিলেন যে, যখন জাপানিরা তাদের বন্ধ দরজা খোলার জন্য মানসিকভাবে তৈরি হয়েছিল। সেজন্য একথা বলা যায় না যে, কমোডর পেরির বলপ্রয়োগের হুমকি জাপান উন্মুক্ত হওয়ার জন্য একমাত্র দায়ী ছি


কানাগাওয়া চুক্তির মাধ্যমে জাপান পাশ্চাত্য শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। বিদেশিদের বাধা দেওয়ার কোনো ক্ষমতা শোগুনের ছিল না। জাপান ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও হল্যান্ডের সঙ্গেও চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছিল। ইংল্যান্ডের সঙ্গে জাপানের চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল ১৮৫৪ সালে, রাশিয়ার সঙ্গে ১৮৫৫ সালে এবং হল্যান্ডের সঙ্গে ১৮৫৬ সালে জাপান চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। কানাগাওয়া চুক্তিতে জাপান আমেরিকাকে 'অতিরাষ্ট্রীয় অধিকার' বা 'Extra territorial rights' দেয়নি। কিন্তু ইংল্যান্ড, রাশিয়া ও হল্যান্ড জাপানের কাছ থেকে ওই অধিকার আদায় করেছি


কানাগাওয়া চুক্তি স্বাক্ষরের পর আমেরিকা কনসাল হিসাবে হ্যারিসকে জাপানে পাঠিয়েছিল। তিনি জাপানকে পুনরায় একটি চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য চাপ দিয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবে শোগুন চাপে পড়ে গিয়েছিল। শোগুনতন্ত্রকে চাপের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য জাপানে একটি গোষ্ঠী সক্রিয় হয়েছিল। এই গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন। নাওসুকে। তিনি শোগুনের প্রধান পরামর্শদাতা হিসাবে কাজ করেছিলেন। মার্কিন দূত হ্যারিস শোগুনকে পুনরায় এক চুক্তি স্বাক্ষরে চাপ দিলে সম্রাট ও তাঁর সমর্থকগণ শোগুনকে এই চুক্তি স্বাক্ষরে বিরত থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু শোগুনোর পরামর্শদাতা নাওমুকে সম্রাটের বিরোধিতাকে গ্রাহ্য করেননি। পরিণামে শোগুন ১৮৫৮ সালে আমেরিকার সঙ্গে পুনরায় এক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। এই চুক্তির নাম হ্যারিসের চুক্তি (Harris Treaty)। এই চুক্তিতে জাপান আরও চারটি বন্দর বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করেছিল। এছাড়া আপান মার্কিনিদের অতিরাষ্ট্রীয় অধিকার দিতে এবং এক নির্দিষ্ট হারের বেশি বাণিজ্য শুল্ক আরোপ না করতে সম্মত হয়েছিল। এর ফলে চীনের ন্যায় জাপান তার সার্বভৌমত্ব অনেকখানি হারিয়েছিল।

এই চুক্তির বিরুদ্ধে জাপানের অভ্যন্তরে তীর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। সম্রাট এই চুক্তিকে অনুমোদন করতে রাজি হননি। তাছাড়া বাণিজ্য শুল্ক কমানোর ফলে বিদেশ থেকে প্রচুর পণ্য জাপানে এসেছিল। বিদেশি পণ্যের সাথে জাপানের কুটির শিল্পজাত পণ্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়েছিল। জাপানের কুটির শিল্প বিরাট ধাক্কা খেয়েছিল। কুটির শিল্পের ক্ষতির ফলে জাপানের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। শাসক টোকুগাওয়া শোষনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ তীব্র হয়েছিল। এই চুক্তি ছিল জাপানিদের কাছে জাতীয় অপমানস্বরূপ। এই চুক্তি স্বাক্ষরকারী টোকুগাওয়া শোগুন জাতীয়তাবাদী জাপানিদের কাছে খলনায়কে পরিণত হয়েছিলেন। জাপানে শোগুন সমর্থক ও বিরোধীদের মধ্যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। এই সংগ্রাম কেবল শোগুনদের বিরুদ্ধে হয়নি, বিদেশিদের বিরুদ্ধেও শুরু হয়েছিল। ব্রিটিশ ও মার্কিন দূতাবাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল। ১৮৫৯ সালে কয়েকজন বিদেশি জাপানিদের আক্রমণে নিহত হয়েছিলেন। শোগুনের প্রধান পরামর্শদাতা নাওসুকে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি শোগুনের অনুকূলে আসেনি। বরং ১৮৬০ সালের মার্চ মাসে নাওসুকে নিহত হয়েছিলেন। মিটো অঞ্চলের একদল উগ্র জাতীয়তাবাদী এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। সি. এল. রিচার্ডসন নামে এক ব্রিটিশ নাগরিককে হত্যা করা হয়েছিল। এই হত্যাকাণ্ড সাংসুমা গোষ্ঠীর নেতৃত্বে হয়েছিল। ব্রিটিশরা হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে শোগুনের কাছে কতকগুলি দাবিপত্র পেশ করেছিল। এই দাবির মধ্যে ছিল ১ লক্ষ পাউণ্ড ক্ষতিপূরণ, ক্ষমাপ্রার্থনা ও হত্যাকারীদের প্রাণদণ্ড প্রদান। জাপান সম্রাট ১৮৬২ সালে এক রাজকীয় ঘোষণায় শোওনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, জাপান থেকে বিদেশিদের বিতাড়ন করতে হবে। কিন্তু শোগুন এই নির্দেশকে মানেননি। চোসু গোষ্ঠীর সেনারা ১৮৬৩ সালের জুন মাসে শিমোনেসিকি প্রণালীতে মার্কিন, ফরাসি ও ওলন্দাজ জাহাজের ওপর আক্রমণ করেছিল। এর পাল্টা জবাব হিসাবে ফরাসি ও মার্কিন যুদ্ধজাহাজ গোলাবর্ষণ করেছিল। ব্রিটিশ বাহিনী রিচার্ডসনের হত্যার জবাব হিসাবে সাংসুমাদের প্রধান কার্যালয় কাগোশিমায় বোমা নিক্ষেপ করেছিল। পরিস্থিতি ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল।


বিক্ষুব্ধ জাপানিরা বিদেশি আক্রমণ প্রতিরোধের অক্ষমতার জন্য শোগুনকে দায়ী করেছিল। তারা সমগ্র দেশে 'Son-o-ji-i' অর্থাৎ 'সম্রাটকে সম্মান দেখাও এবং বিদেশিদের তাড়াও' এই স্লোগান তুলেছিল। জাপানে বিদেশিদের বিরুদ্ধে আক্রমণ বেড়েছিল। এইসব ঘটনার পরিণতিতে জাপানের শাসক শোগুনের অবস্থান দুর্বল হয়েছিল। তারা বিদেশিদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি।

অভ্যন্তরীণ শাস্তিও তারা বজায় রাখতে পারেনি। জাপানে বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে এতদিন যে ভারসাম্য ছিল, তা নৈরাজ্যের কবলে পড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আইন ও শৃঙ্খলার দ্রুত অবনতি শোগুনের শক্তি ও জনপ্রিয়তাকে নষ্ট করেছিল। বিদেশিদের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী জাপানিদের আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য বিদেশিরা সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। বিদেশিদের সাথে জাপানিদের যে সংগ্রাম হয়েছিল, তাতে জাপানিরা কাগোশিমা (Kagoshima) এবং শিমোনোসিকি (Shimonoseki)-তে পরাজিত হয়েছিল [পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।] এই পরাজয় দেশপ্রেমিক জাপানিদের বিশেষ করে যোদ্ধা সামুরাই শ্রেণীর মনে শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল। তারা যুগোপযোগী সংস্কারের মাধ্যমে জাপানকে পুনরায় শক্তিশালী করে গড়ে তোলার জন্য আহ্বান জানিয়েছিল।


এইসব ঘটনা শোগুনতন্ত্রের পতনের পথকে প্রশস্ত করেছিল। জাপানি নেতারা উপলব্ধি করেছিল যে, চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত প্রাচীন সমাজব্যবস্থা ক্রমশ অচল হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে এইসময় এক ধনী বণিক শ্রেণীর এবং বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটায়, তারা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের জন্য দাবি জানিয়েছিল। বিদেশি বিরোধী যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা ক্রমশ নিস্তেজ হয়েছিল। কিন্তু শোগুন বিরোধী আন্দোলন কমেনি। বরং বেড়েছিল।


জাপানের বুদ্ধিজীবীরা প্রাচীন ইতিহাসচর্চা করে দেখেন যে, প্রাচীনকালে জাপানের প্রকৃত শাসক ছিলেন জাপানের সম্রাট স্বয়ং। পরবর্তীকালে শোওনরা জোরপূর্বক বা অবৈধ উপায়ে সম্রাটের কাছ থেকে সব ক্ষমতা দখল করেছে। জাপানের বুদ্ধিজীবীরা সম্রাটের হাতে সব ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করেছিল। তাদের বক্তব্য ছিল সম্রাট তাঁর হৃত ক্ষমতা ফিরে পেলে জাপানে আবার শান্তি ও সমৃদ্ধি ফিরে আসবে এবং জাপান পুনরায় শক্তিশালী হয়ে উঠবে। তাদের আন্দোলনে জাপানে শোগুনতন্ত্রের পতনের পথ যেমন তৈরি হয়েছিল, তেমনি জাপানের সম্রাটের হাতে শাসনক্ষমতা ফিরে পাওয়া অর্থাৎ রেস্টোরেশনের পটভূমিকা তৈরি হয়েছিল।


জাপানে রেস্টোরেশনের সমর্থকদের সাথে শোগুন সমর্থকদের মধ্যে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল। শোগুনদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে জাপানের চারটি শক্তিশালী সামস্তগোষ্ঠী মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। তারা হল যথাক্রমে শক্তিশালী পরাক্রান্ত সাৎসুমা ও চোসু গোষ্ঠী এবং অপেক্ষাকৃত দুর্বল হিজেন ও তোসাৎ গোষ্ঠী। এই সামস্ত গোষ্ঠীগুলি শোগুনবিরোধী আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য পরস্পরের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। ১৮৬৭ সালে শোগুনবিরোধী সংগ্রাম চরম আকার ধারণ করেছিল। ওই বছরে শোগুন পদে আসীন হয়েছিলেন তরুণ কেইকি (Keike)।

একই বছরে সম্রাট কামেকি মৃত্যুবরণ করেছিলেন এবং ১৫ বছর বয়সী পুত্র মেইজি সম্রাট পদে অভিষিক্ত হয়েছিলেন। এই নতুন সম্রাট ছিলেন সংস্কারমুক্ত ও উদারমনস্ক। তিনি শোষনতন্ত্রের বিরোধী ছিলেন। তাঁর সম্রাট পদে আসীন হওয়ার পরিণতিতে সাংসুমা, চোসু, হিজেন ও তোসাদের শোগুন বিরোধী আন্দোলন আরও জোরদার হয়েছিল। শোগুন বিরোধীরা শোগুনকে এক স্মারকপত্র পেশ করেছিল। এই স্মারকপত্রে তারা শোগুনকে পদত্যাগ করে সব প্রশাসনিক ক্ষমতা সম্রাটকে ফিরিয়ে দিতে বলেছিল। শোগুন কেইকি অনুভব করেছিলেন যে, টোকুগাওয়া গোষ্ঠীর হাতে আর ক্ষমতা থাকবে না। তাদের দিন শেষ হতে চলেছে। তাই ১৮৬৭ সালের নভেম্বর মাসে তিনি স্বেচ্ছায় শোওনদের সব ক্ষমতা সম্রাটের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এইভাবে সম্রাট মেইজির আমলে জাপানের সম্রাটরা দীর্ঘদিন পর তাদের ক্ষমতা ফিরে পেয়েছিলেন। এই ঘটনা জাপানের ইতিহাসে Meiji Restoration নামে পরিচিত। এরপরও শোগুনদের কিছু ক্ষমতালোলুপ অনুগত ব্যক্তি শোগুনদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে আনার জন্য বিদ্রোহ করেছিল। কিন্তু মাসুমা ও চোসু গোষ্ঠীর নেতারা তাদের বাসনাকে চূর্ণ করেছিল।




Post a Comment

0 Comments