পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলিতে সোভিয়েত রাশিয়ার নেতত্বে সাম্যবাদের বিস্তার সম্বন্দ্বে আলোচনা করো। অথবা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাশিয়া কীভাবে পূর্ব ইউরোপে তার প্রাধান্য স্থাপন করেছিল?
ভূমিকা:
বহু বছর ধরেই পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির স্বাধীনতা অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী রাষ্ট্রের দ্বারা বারবার বিঘ্নিত হয়েছে। ওইসব শক্তিশালী দেশের মধ্যে পরবর্তীকালে বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত রাশিয়া অন্যতম হলেও তার আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদ বা সাম্রাজ্যবাদের পরিবর্তে সাম্যবাদের বিস্তার ঘটানো।
রুশ-জার্মান দ্বন্দ্বের মাধ্যমে :
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রক্ষার সূত্রেই পূর্ব ইউরোপে বেশ কয়েকটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু তিনের দশকে নাৎসি জার্মানি পূর্বদিকে সাম্রাজ্য-বিস্তারনীতি গ্রহণ করলে ওইসব রাজ্য জার্মানির পদানত হয়। এইভাবে জার্মানির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজ অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে সোভিয়েত রাশিয়া শঙ্কিত হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত রাশিয়ার লালফৌজই সমগ্র পূর্ব ও মধ্য ইউরোপকে জার্মানির কবলমুক্ত করে ওইসব অঞ্চলে সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে।
• সোভিয়েত রাষ্ট্রজোট গঠনের দ্বারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে সোভিয়েত রাশিয়া সরাসরি নিজের অঙ্গীভূত করে নেয়। এরপর পূর্ব ইউরোপের যুগোশ্লাভিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়া, আলবানিয়া, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া, পোল্যান্ড ও পূর্ব জার্মানি—এই আটটি দেশকে কমিনফর্মের অন্তর্ভুক্ত করে। অবশ্য অল্পকাল পরে যুগোশ্লাভিয়া কমিনফর্ম থেকে বিতাড়িত হয়। এরপর পূর্ব ইউরোপের বাকি দেশগুলিতে সমাজতন্ত্র তথা সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে সাম্যবাদ দৃঢ়ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়।
সোভিয়েতের উদ্দেশ্য:
সোভিয়েত রাশিয়ার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যেসব উদ্দেশ্যে তা হল সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের বিস্তার ঘটানো: সমস্ত বিষর্থী শক্তিই পরাজিত শক্তিসমূহের ওপর নিজেদের মতাদর্শ, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা ইত্যাদি চাপিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। তার ওপর বিশ্বের সর্বত্র সাম্যবাদী ভাবধারা বিস্তারের লক্ষ্যে ওই অঞ্চলের ওপর সোভিয়েত রাশিয়ার আধিপত্য স্থাপনের প্রয়োজন তো ছিলই। কাজেই এ ব্যাপারে সোভিয়েত রাশিয়ার দিক থেকে তার প্রচেষ্টা যুক্তিযুক্তই ছিল।
শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাব :
ইউরোপের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুর্বল হয়ে পড়ে। সেই সুযোগ সোভিয়েত রাশিয়াকে পূর্ব ইউরোপে আধিপত্য বিস্তারে উৎসাহিত করে।
জোটবদ্ধতা:
প্রাক্-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে কূটনৈতিক দিক থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন যে বিচ্ছিন্ন ছিল, ত থেকে মুক্তি পেতে সে একটি নিজস্ব জোট গড়ে তুলতে উৎসাহী ছিল। তাই, বিশ্বরাজনীতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের উদ্দেশ্যও এ ব্যাপারে সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে কাজ করেছিল।
পূর্ব ইউরোপে বশীকরণের পদ্ধতি :
পূর্ব ইউরোপকে রূশীকরণ করতে সোভিয়েত রাশিয়া পাঁচটি স্তরবিশিষ্ট একটি বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করেছিল। সেগুলি হল- রুশ নিয়ন্ত্রণাধীন অস্থায়ী সরকার গঠন : (i) একটি সোভিয়েত ইউনিয়ন ওইসব দেশের প্রতিষ্ঠিত সরকারকে 'ফ্যাসিবাদী', 'প্রতিক্রিয়াশীল' ইত্যাদি আখ্যা দিতে শুরু করে। তারপর সেখানে পপুলার ফ্রন্ট নামে সর্বদলীয় একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। এই সরকারকে এমনভাবে পড়া হয়, যাতে তার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কেবল কমিউনিস্টদের হাতে থাকে।( ii) অ-কমিউনিস্টদের উৎখাত: এর পরের স্তরে সেখানে অ-কমিউনিস্ট গোষ্ঠীগুলিকে ধীরে ধীরে ঠান্ডা মাথায় উৎখাত করে মন্ত্রীসভার সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ—বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দফতর কমিউনিস্টদের অধীনে আনা ও একদলীয় কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠা : সেখানে সমস্ত অ-কমিউনিস্ট মন্ত্রীদের বিতাড়িত করে কমিউনিস্টদের একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়। (iii) নতুন শাসনতন্ত্র রচনা ও প্রবর্তন : দেশগুলিতে সোভিয়েত রাশিয়ার অনুকরণে একটি নতুন শাসনতন্ত্র রচনা করে নিয়ন্ত্রিত গণভোটের মাধ্যমে সেই শাসনতন্ত্র প্রবর্তন করা হয়। (iv) রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল: এইভাবে সেখানকার কমিউনিস্ট পার্টি বিরোধী দলগুলিকে দমন করে রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা দখল করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, যানবাহন, ধর্মস্থান, সংবাদপত্র, এমনকি ব্যক্তিস্বাধীনতা— সমস্ত কিছুর ওপর দলীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়।
পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত কাঠামো:
পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত অনুগত রাষ্ট্রগুলির ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থায়ীভাবে বজায় রাখতে সোভিয়েত রাশিয়া যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলেছিল তার দুটি দিক ছিল অর্থনৈতিক ও সামরিক। আসলে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিকে আমেরিকার মার্শাল পরিকল্পনার প্রলোভন থেকে রক্ষা করে সেখানে সাম্যবাদকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যই সোভিয়েত রাশিয়াকে এরকম একটা শক্ত পরিকাঠামো গড়ে তুলতে বাধ্য করেছিল।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্র:
পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে আর্থিক ক্ষেত্রে সংহতি গড়ে তুলতে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে গঠন করা হয় পারস্পরিক আর্থিক সহায়তা পরিষদ (Council for Mutual Economic Assistance) বা কমিকন (COMECON)। এ ছাড়া দেশগুলির আর্থিক পুনরুজ্জীবনের জন্য দ্রুত শিল্পায়ন, কৃষিক্ষেত্রে যৌথ খামার ব্যবস্থার প্রবর্তন ইত্যাদি নীতি গ্রহণ করা হয়।
সামরিক ক্ষেত্র:
সামরিক দিক থেকে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিকে সোভিয়েত রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল করে তোলার জন্য ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারশ চুক্তি সংস্থা (W.P.O.) গঠন করা হয়। তদানীন্তন সোভিয়েত প্রতিরক্ষামন্ত্রী বুলগানিন সংস্থাটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।
পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত সম্প্রসারণের চরিত্র:
পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত সম্প্রসারণের কয়েকটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। সেগুলি হল— (i) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতির সুযোগে ওই অঞ্চলে সোভিয়েত রাশিয়ার আধিপত্য তথা সাম্যবাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। (ii) পূর্ব ইউরোপের ওইসব দেশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার নিজ রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত করেনি। (iii) সোভিয়েত বশংবদ বিশেষত স্টালিনের একান্ত অনুগত ব্যক্তিকেই ওইসব অঞ্চলের শাসক হিসেবে মানা হত। (iv) ওইসব রাষ্ট্রে স্থানীয় জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা জাতীয় স্বার্থ ও আর্থসামাজিক স্বাস্থা বলে কিছুই ছিল না— স্টালিনই ছিলেন শেষকথা। ওইসব রাষ্ট্রে অ-কমিউনিস্ট বা সোভিয়েত তথা স্টালিন বিরোধীদের নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হত। গুপ্তহত্যা হত যথেচ্ছ।
উপসংহার:
পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রভাব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। সোভিয়েত রাজনীতি বিশেষজ্ঞ হিউ সেটন ওয়াটসন তাঁর 'দ্য ইস্ট ইউরোপীয়ান রেভোলিউশান' গ্রন্থে পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত প্রাধান্য এক ‘সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা' বলে উল্লেখ করেছেন। আবার, ডেভিড হরোউইডের মতে—পূর্ব ইউরোপে ঠান্ডা লড়াইয়ের রাজনীতি এবং সোভিয়েত সাম্যবাদকে আটকানোর চেষ্টা সোভিয়েত রাশিয়াকে পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলিতে সাম্যবাদের প্রসারে আরও উজ্জীবিত করে তুলেছিল।
নিরাপত্তা-বলয় গঠন:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সেনা সোভিয়েত রাশিয়ার ওপর আক্রমণ হেনেছিল। কাজেই যুদ্ধপরবর্তী সময়েও নিরাপত্তার তাগিদে ওই অঞ্চলের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে একটা নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা সোভিয়েতের কাছে খুবই জরুরি ছিল।
আর্থিক পুনরুজ্জীবন :
নিজের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের জন্য সম্পদ আহরণ এবং নিজস্ব শিল্পজাত পণ্যের বাজার হিসেবেও পূর্ব ইউরোপ সোভিয়েত রাশিয়ার কাছে ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ।
0 Comments
If you like the posts, you must comment. and if there is any problem , please let me know in the comments.