প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রধারণার তুলনামূলক আলোচনা করো। 8
উত্তর:
প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রধারণার তুলনামূলক আলোচনা:
প্রাচীন গ্রিসের রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে প্লেটো এবং তাঁর শিষ্য অ্যারিস্টটল অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন। সমসাময়িক দার্শনিকগণ এবং পরস্পরকে প্রভাবিত করা সত্ত্বেও প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে উভয়ের মধ্যে বিপরীতধর্মী গতিশীলতা লক্ষ করা যায়। উভয়ের রাষ্ট্রচিন্তার মৌলিক পার্থক্য লক্ষ করেই Friedrich Schlegel মন্তব্য করেছেন, "Every man is born either a platonist or an Aristotelian." (প্রতিটি মানুষ হয় প্লেটোবাদী নয় অ্যারিস্টটলের অনুগামী হিসেবে জন্মগ্রহণ করে)।
সাদৃশ্য:
1. গ্রিক সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা:
অ্যারিস্টটল এবং প্লেটো উভয়েই গ্রিক নগররাষ্ট্রের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। অ্যারিস্টটলের The Politics গ্রন্থের সূচনাতেই বলা হয়েছে, নগররাষ্ট্রের মধ্যে দিয়ে মানুষের নাগরিক জীবনের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশ ঘটে। প্লেটোর The Republic গ্রন্থেও এই ধারণার প্রতিফলন লক্ষ করা গেছে।
2. গ্রিক সমাজ ও সভ্যতার সংকট সম্পার্ক মত:
প্লেটো ও অ্যারিস্টটল উভয় দার্শনিককেই গ্রিক সমাজ ও সভ্যতার সংকট গভীরভাবে বিচলিত করে তুলেছিল। তাঁরা দুজনেই মনে করতেন, ধ্রুপদি মূল্যবোধ ও নৈতিক বিশ্বাস থেকে বিচ্যুতিই রাষ্ট্রীয় জীবনের ঐক্যকে নষ্ট করেছে। পাশাপাশি, উভয়েই তাঁদের গ্রন্থে সমকালীন দুরবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যে পন্থার ভিন্নতা থাকলেও উদ্দেশ্য কিন্তু আলাদা ছিল না।
3.কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণা:
প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল উভয়েই একথা মনে করতেন যে, এক নৈতিক জীবন তথা সৎ ও মহৎ জীবনযাপনের মধ্যেই নিহিত আছে ব্যক্তিজীবনের সাফল্য। উভয়েই বলেন যে- নাগরিক জীবনের পরিপূর্ণ উপলব্ধি নগররাষ্ট্রের মধ্যেই সম্ভব।
4.
জৈব মতবাদে বিশ্বাস:
প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল দুজনেই জৈব মতবাদে বিশ্বাস করতেন। প্লেটোর কাছে সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের কল্যাণের প্রশ্নটিই বেশি গুরুত্ব লাভ করেছে। প্লেটোর মতো তীব্রভাবে না হলেও অ্যারিস্টটল রাষ্ট্রের কল্যাণ-অকল্যাণের সঙ্গে ব্যক্তিবিশেষের সুখ-দুঃখকে একাত্ম করেছেন। তিনি আরও বলেছেন যে, রাষ্ট্রের সংকট ব্যক্তির জীবনের পক্ষেও সংকটস্বরূপ। পাশাপাশি বলা যায়, এই দুই দার্শনিকই রাষ্ট্রের স্বার্থে যা কিছু কল্যাণকর তাকে সমর্থন জানিয়েছেন।
বেসাদৃশ্য:
1. আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা প্রসঙ্গে বিপরীতধর্মিতা:
সমকালীন এথেন্সের নানাবিধ সমস্যা ও সংকট থেকে শান্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে প্লেটো সত্য ও ন্যায়নীতির প্রতীকরূপে আদর্শ রাষ্ট্র গঠনে উদ্যোগী হন। কল্পিত রাষ্ট্রে শাসকের মহত্ব, নৈতিকতা, শাসন ও শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে ন্যায়নির্ভর সমাজ ও রাষ্ট্রের সন্ধান করেছেন তিনি। অন্যদিকে বাস্তব রাষ্ট্রের গুণাবলি ও বিভিন্ন ত্রুটি থেকে শিক্ষা নিয়ে অ্যারিস্টটল মূলত আদর্শ রাষ্ট্রের উপাদান সংগ্রহ করেন।
2. রাষ্ট্রের ঐক্য সম্পার্ক দ্বিমত:
রাষ্ট্রের ঐক্য সম্পর্কে প্লেটোর অভিমত অ্যারিস্টটল কর্তৃক স্বীকৃত হয়নি। প্লেটোর মতে, 'রাষ্ট্রের পরম ঐক্যই চরম মঙ্গল', কিন্তু অ্যারিস্টটল প্লেটোর এই বক্তব্য সঠিক বলে মনে করেননি। তিনি মনে করেছেন, রাষ্ট্র নিরন্তর একত্বের পথে ক্রমাগত অগ্রসর হতে হতে ক্রমশ তার নিজস্ব সত্তা (রাষ্ট্রত্ব) হারিয়ে ফেলবে।
3. শাসনপদ্ধতি সম্পর্কে ভিন্নমত :
পর্যায়ক্রমিকভাবে শাসক ও শাসিত হওয়ার নীতিকে ত্যাগ করে প্লেটো একটি গোষ্ঠীকে স্থায়ী শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে অ্যারিস্টটল মনে করেন যে, পর্যায়ক্রমে সব শ্রেণির মানুষ শাসনকাজে অংশগ্রহণ করবে।
4. সাম্যবাদ প্রসঙ্গে দ্বিমত :
প্লেটো ও অ্যারিস্টটল উভয়ে জৈবতত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন, তা সত্ত্বেও অ্যারিস্টটল সমষ্টিবাদ বা সাম্যবাদের প্রচারক ছিলেন না। প্লেটোর বিশ্বাস ছিল, বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় ঐক্য তথা কল্যাণের জন্য ব্যক্তি নিজেদের রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপে উৎসর্গ করবে।অপরদিকে অ্যারিস্টটল ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের জন্য বিসর্জন দিতে চাননি।
তবে মিল-অমিল যাই থাকুক না কেন, পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার জগতে প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের চিন্তা বর্তমানে যথেষ্ট সমাদৃত এবং অনুসরণযোগ্য।
0 Comments
If you like the posts, you must comment. and if there is any problem , please let me know in the comments.