টোকুগাওয়া শোগুনতন্ত্রের পতনের কারণ (টোকুগাওয়া শোগুনাতের প্রধান পতন কী ছিল):
টোকুগাওয়া শোগুনতন্ত্রের একটি কেন্দ্র |
জাপানের টোকুগাওয়া গোষ্ঠী শোগুনপদকে প্রায় আড়াইশো বছর অধিকার করে রেখেছিল। মিনা মোটো জোরিটোমোর হাত ধরে যে শোগুনতন্ত্রের সূচনা হয়েছিল, তার সমাপ্তি ঘটেছিল শেষ শোগুন কেইকি বা যোশিনোবুর ১৮৬৭ সালে পদত্যাগের মাধ্যমে। এই দীর্ঘ শাসনপর্বে শোগুন ছিল জাপানের প্রকৃত শাসক। জাপানি সম্রাটের কোনো ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে জাপানে পরিস্থিতিরপরিবর্তন হয়েছিল। টোকুগাওয়া শোগুনতন্ত্রের ভিত দুর্বল হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত টোকুগাওয়া গোষ্ঠীর শেষ প্রতিনিধি কেইকি ১৮৬৭ সালে পদত্যাগ করলে জাপান থেকে দীর্ঘদিনের টোকুগাওয়া শোগুন শাসনের অবসান হয়েছিল। স্বাভাবিক কারণে প্রশ্ন জাগে টোকুগাওয়া শোগুনতন্ত্রের পতনের পিছনে কী কারণ দায়ী ছিল? এর উত্তর নিয়ে পণ্ডিতি বিতর্কের শেষ নেই। G. C. Allen, Sir George Sansom এবং W Elliot Griffis প্রমুখ পণ্ডিত মনে করেন অভ্যন্তরীণ সংকট ও আর্থিক সংকট শোগুন শাসনের পতনের মূল কারণ। Allen তাঁর A Short Economic History of Modern Japan গ্রন্থে আর্থিক সংকটকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। অন্যদিকে Reischauer-এর মতো পণ্ডিতরা বহির্বিশ্বের চাপকে শোগুনদের পতনের প্রধান কারণ বলে মনে করেন। আমরা খুব সংক্ষেপে এই বিষয়টিকে নিয়ে আলোচনা করব।
(মেইজি রেষ্টরেশন এর পটভূমি পড়তে হলে এই লিংকে ক্লিক করুন)
এতে কোনো সন্দেহ নেই টোকুগাওয়া শোগুনতন্ত্রের দীর্ঘ শাসনকালে জাপানে মোটামুটি অভ্যন্তরীণ শান্তি বজায় ছিল। উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত জাপানে কোনো বিদেশি আক্রমণ হয়নি। এসবের পরিণতিতে জাপানে সমৃদ্ধি এসেছিল। কিন্তু উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে জাপানে আর্থিক ও সামাজিক পরিবর্তন শুরু হয়েছিল। শিল্প-বাণিজ্যের অগ্রগতি ও বিস্তার হয়েছিল। প্রচলিত জাপানি সমাজে বণিকদের ..... কোনো সামাজিক মর্যাদা ছিল না। কিন্তু বাণিজ্যের সম্প্রসারণ হলে বণিকদের হাতে যথেষ্ট অর্থ এসেছিল। জাপানে খুব দ্রুত সামন্ত প্রথার অবক্ষয় শুরু হয়েছিল এবং আধুনিক ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছিল। এই পরিবর্তন টোকুগাওয়া শাসনের... ভিতকে দুর্বল করেছিল। সামস্ত জমিদাররা ও যোদ্ধা সামুরাই শ্রেণী টোকুগাওয়া শাসনের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। জাপানে অস্থির পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল। পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করার সামর্থ্য টোকুগাওয়াদের ছিল না। তাই তাদের পতন ছিল অবধারি।
(টোকুগাওয়া শোগুনতন্ত্রের পতনের পিছনে অভ্যন্তরীণ সংকটকে অস্বীকার করা যায় না। শোগুনদের দুর্নীতি ছিল মাত্রাছাড়া। জাপানের সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে শোগুনতন্ত্র আস্থা হারিয়েছিল। জন-সমর্থন বঞ্চিত কোনো শাসন টিকতে পারে না। শোগুনতন্ত্র তার ব্যতিক্রম ছিল না। প্রথমদিকের শোগুনরা ছিলেন শক্তিশালী শাসক। কিন্তু পরবর্তীকালের শোগুনরা ছিলেন অযোগ্য। তাঁরা অনুগত কর্মচারীদের ওপর প্রশাসনের দায়িত্ব ছেড়ে বিলাসবাসনে দিন কাটাতেন। যে কোনো প্রশাসনে প্রশাসকের যোগ্যতা শাসনকে টিকিয়ে রাখার অন্যতম শর্ত। যতদিন পর্যন্ত শোগুনরা নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পেরেছিলেন, ততদিন শোগুনদের বিরুদ্ধে কোনো প্রশ্নবোধক চিহ্ন আসেনি। কিন্তু ধীরে ধীরে শোগুনরা তাদের প্রশাসনিক যোগ্যতা হারিয়েছিল। প্রশাসনের সার্বিক উন্নতির পরিবর্তে তারা বিলাসে নিজেদের জড়িয়েছিল। জনগণের মঙ্গলবিধানের কোনো চেষ্টা তাদের মধ্যে ছিল না। স্বাভাবিকভাবে স্বার্থান্বেষী বিলাসপ্রিয় শোগুনদের বিরুদ্ধে জনরোষ শুরু হয়েছিল। জনগণের মনে এই ধারণা জন্মেছিল যে, সম্রাটের হাতে শাসনক্ষমতা এলে জাপানের হতাশাপূর্ণ দিনের সমাপ্তি হবে। ইংরেজ ঐতিহাসিকত।আর্নল্ড টয়েনবি মনে করেন শাসকশ্রেণী যখন সৃজনীশক্তি হারিয়ে অপদার্থ হয়ে যায়, তখন সেই সভ্যতার পতন ঘটে। জাপানের শোগুন শাসকেরা এই পথেই চলেছিলেন। তাদের প্রশাসনিক দক্ষতা ও যোগ্যতার অভাব তাদের পতনকে নিশ্চিত করেছিল। ) - অভ্যন্তরীণ সংকটের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল আর্থিক সংকট। জাপানের অর্থনৈতিক সংকট শোগুনতন্ত্রকে দুর্বল করেছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মেইজি যুগের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রিন্স মাসকাটা (Prince Matsukata) অর্থনৈতিক সংকটকে শোগুনতন্ত্রের পতনের পিছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে মনে করেন। আধুনিক অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ অ্যালেনও (Allen) টোকুগাওয়া শোগুনতন্ত্রের পতনের জন্য আর্থিক সংকটকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এটা ঠিক যে, শোগুনতন্ত্রের প্রথমদিকে বিশেষ করে সপ্তদশ শতকের প্রথমদিকে জাপানের আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে শোগুনদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রার প্রতি ঝোঁক তাদের প্রশাসনে শিথিলতা এনে দিয়েছিল। প্রশাসনিক দুর্নীতি ও আর্থিক সংকট জাপানের নিত্যসঙ্গী হয়ে পড়েছিল। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ। অষ্টাদশ শতকের প্রথমদিকে জাপানে ভয়ংকর ভূমিকম্প ও অগ্নিকাণ্ড হয়েছিল। জাপানের অর্থনীতির ওপর এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ তীব্র আঘাত হেনেছিল। শোগুনতন্ত্র এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে মোকাবিলা করার জন্য রাজকোষ থেকে প্রচুর অর্থব্যয় করতে বাধ্য হয়েছিল। পরিণতিতে জাপানি রাজকোষে ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। অর্থসংকট ঘনীভূত হয়েছিল। অবশ্য শোগুনরা এই অর্থসংকটকে সামাল দেবার চেষ্টা করেছিল। সেজন্য অর্থনীতিতে কিছুটা স্থিতিশীলতা এসেছিল। জাপানের অর্থকরী ফসল বিশেষ করে ধানের উৎপাদন বেশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। খনিজ সম্পদ থেকেও অর্থ সমাগম হয়েছিল। বাণিজ্যের সম্প্রসারণ হয়েছিল। এসবের পরিণতিতে জাপানের অর্থনীতির স্থাণুত্ব কিছুটা কেটেছিল, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত ছিল, তা বলা যাবে না। কারণ বহির্বাণিজ্য জাপানে ছিল না বললেই চলে। সরকারের আয়-ব্যয়ের মধ্যে কোনো সমতা ছিল না। শোগুনরা দেশের নিরাপত্তার জন্য বেশ কিছু যুদ্ধজাহাজ কিনেছিল, দুর্গ নির্মাণ ও সংস্কার করেছিল। ফলস্বরূপ খরচের বরাদ্দ বেড়েছিল। কিন্তু সেই অনুপাতে রাজস্ব বাড়েনি। টেম্পো যুগে (১৮৩০-৪৩) সরকারি খরচ আরও বেড়েছিল। বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ বেড়েছিল। রাজকর্মচারীদের দুর্নীতি মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। মুদ্রার মূল্য হ্রাস পেয়েছিল। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিতথ্য সহকারে এটা প্রমাণ করেছেন যে, কৃষক বিদ্রোহের জন্যই টোকুগাওয়া শোগুনতন্ত্রের পতন হয়েছিল। এটা ঠিক যে, শোগুনদের পতনের পিছনে কৃষি ও কৃষক অসন্তোষের গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা ছিল। জাপানি কৃষকদের অধিকাংশের নিজের জমি ছিল না। তারা খাজনার বিনিময়ে জমিদারদের জমি চাষ করত। প্রথমদিকে চাল ছিল বিনিময়ের মাধ্যম। পরবর্তীকালে সরকার মুদ্রার প্রচলন করলে কৃষকরা বিপদে পড়েছিল। গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি শোগুনতন্ত্র নেয়নি। কৃষি ঋণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। জলসেচের কোনো বিকল্প ব্যবস্থা ছিল না। প্রকৃতির করুণার ওপর জাপানে কৃষি নির্ভরশীল ছিল। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ভূমিকম্প—এইসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ জাপানের কৃষি অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলত। জমিদার বা ডাইমোরা কৃষি ও কৃষককে উন্নতির দিকে কোনো নজর দিত না। এইসবের পরিণতিতে জাপানে কৃষক বিদ্রোহ হয়েছিল। ভারতের মোঘল শাসনের পতনে যেমন কৃষি ও কৃষক বিদ্রোহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল, তেমনি জাপানের শোগুনতন্ত্রের পতনেও কৃষক বিদ্রোহের ভূমিকা ছিল। পেয়েছিল। চাল নিয়ে দাঙ্গা হয়েছিল। দুর্ভিক্ষ, মড়ক ও আর্থিক সংকট শোগুনতন্ত্রকে দিশেহারা করে দিয়েছিল। শোগুনরা কৃষকদের ওপর থেকে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের চেষ্টা করেছিল। কৃষকরা এই অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। কৃষক বিদ্রোহ শোগুনতন্ত্রের পতনের পথকে প্রশস্ত করেছিল। কৃষক সম্প্রদায়ের উন্নতির দিকে শোগুনদের কোনো নজর ছিল না। বরং তাদের ওপর অতিরিক্ত কর চাপানো হয়েছিল। কৃষকরা অসন্তুষ্ট হয়ে বিদ্রোহ করেছিল। ই. এইচ. নর্মান, হিউ বার্টন, জন হ্যালিডে প্রমুখ ঐতিহাসিক(শোগুনতন্ত্রের পতনের পিছনে জমিদার বা ডাইমোদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কৃষক বিদ্রোহের পরিণতিতে কৃষি সংকট শুরু হয়েছিল। কৃষি থেকে ডাইমোদের আয় কমে গিয়েছিল। কিন্তু তাদের খরচ কমেনি, বরং বেড়েছিল। ডাইমোরা শহরে বিলাসবহুল জীবনযাপন করত। তারা বাধ্য হয়ে বণিকদের কাছে ঋণ নিয়েছিল। সামন্ততন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টা বেজেছিল। ডাইমোরা তাদের এই বিপর্যয়ের জন্য শোগুনতন্ত্রকে দায়ী করেছিল।)
← শোগুনতন্ত্রের পতনের পিছনে যোদ্ধা সামুরাই শ্রেণীরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সামুরাই শ্রেণী ছিল যোদ্ধা শ্রেণী। টোকুগাওয়া শোগুনদের শাসনে জাপানে দীর্ঘদিন শান্তি বজায় ছিল। ফলে যোদ্ধা সামুরাই শ্রেণীর কোনো কাজ ছিল না। যুদ্ধ না থাকায় এই শ্রেণীর পেশাদারি গুরুত্ব কমে গিয়েছিল। ডাইমোদের কাছে এই শ্রেণী হয়ে পড়েছিল বোঝাস্বরূপ। সামুরাইদের প্রাপ্য ভাতা কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারা আর্থিক সংকটে পড়েছিল। স্বাভাবিক কারণে সামুরাই শ্রেণী শোগুনতন্ত্রের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। সামুরাই শ্রেণী যাতে শোগুনতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনে শামিল না হয়, তার জন্য সচেষ্ট হয়েছিল। তারা সামুরাই শ্রেণীকে সাংস্কৃতিক চর্চায় মনোনিবেশ করার জন্য উৎসাহিত করেছিল। অসন্তুষ্ট সামুরাই শ্রেণী সংস্কৃতিচর্চায় মন দিয়েছিল। ফলে ..... জাপানে সাংস্কৃতিক জাগরণ হয়েছিল। এই সাংস্কৃতিক জাগরণকে কেন্দ্র করে জাপানে সাহিত্যচর্চা ও ইতিহাসচর্চা নতুন রূপ নিয়েছিল। ১৭১৫ সালে মিটোর (Mito) প্রিন্স কোমোন (Prince Komon) রচনা করেন ডাই-নিহন শি(Dai-Nihon Shi)। প্রখ্যাত পণ্ডিত রায় শ্যানো (Rai Sanyo) রচনা করেন নিহন-গাই-শি (Nihon Gwai-Shi) এবং সেইকি(Seiki)। এছাড়াও জাপানের প্রাচীন ইতিহাস কো-জিকি (KoJiki) এবং নিহোনজি (Nihonji)-কে পুনরায় সংকলিত করা হয়েছিল। এরফলে জাপানে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ ঘটেছিল। সামুরাই শ্রেণী প্রচার করেছিল যে, প্রাচীনকালে জাপানের প্রকৃত শাসক ছিলেন স্বয়ং সম্রাট, শোগুনরা নয়। তাঁরা কল্পনা করেন যে, প্রাচীন যুগে সম্রাটের অধীন জাপানের নাগরিকেরা এক সুন্দর মনোরম স্বর্গরাজ্যে বাস করতেন। শোগুন অন্যায়ভাবে সম্রাটকে বঞ্চিত করে শাসনক্ষমতা দখল করেছে। যদি সম্রাটের হাতে আবার ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে জাপানে বর্তমানে যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, তার অবসান হবে এবং জাপানিরা স্বর্গসুখে বাস করবে। সামুরাই শ্রেণীর জন্য মানসিক দিক দিয়ে সম্রাটের ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল। সম্রাটের প্রতি জনগণের আনুগত্য বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং শোগুনদের প্রতি জনসমর্থন কমেছিল। শোগুন যে উদ্দেশ্য নিয়ে দেশে সাংস্কৃতিক কার্যকলাপে উৎসাহ নিয়েছিলেন, তা কেবল ব্যর্থ হয়নি, বরং তার পতনের দিন সমাগত হয়েছিল। এইসময় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ হয়েছিল এবং সম্রাটের প্রতি জনগণের আনুগত্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। চীনা দার্শনিক ওয়াং-ইয়াং-মিং-এর রচনা জাপানিদের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। জনগণের মনে স্বাধীন চেতনার বিকাশ ঘটেছিল। জাপানিদের মনে শোগুনতন্ত্রের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন জেগেছিল। জাপানের শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল।
শোগুনতন্ত্রের পতনের পিছনে ধর্মের ভূমিকাকেও অস্বীকার করা যায় না। শোগুনরা বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। স্বাভাবিকভাবে জাপানে বৌদ্ধধর্ম রাজধর্মে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু অধিকাংশ জাপানি শিন্টো ধর্মে দীক্ষিত ছিলেন। শিন্টো ধর্মমত অনুযায়ী জাপানের প্রকৃত শাসক ছিলেন সম্রাট। শোগুনরা অন্যায়ভাবে সম্রাটকে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করে শাসনক্ষমতা হস্তগত করেছে। শিন্টো ধর্মীয় মানুষের কাছে শোগুনরা ছিল. অবৈধ ক্ষমতার অধিকারী। জনগণ জাপানি সম্রাটের হাতে শাসনক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করেছিল। জাপানি বুদ্ধিজীবীরা সম্রাটকে কেন্দ্র করে নতুন এক বৌদ্ধিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। এই আন্দোলনকে জনপ্রিয় করেন। নোবুনাগা মোটুরি। আন্দোলনকারীরা সম্রাটকে শ্রদ্ধা জানানোর কথা বলেছিলেন। সম্রাটের ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্র যেমন এর দ্বারা প্রস্তুত হয়, তেমনি শোগুনদের পাতন নিশ্চিত হয়েছিল।
জাপানি বুদ্ধিজীবীরা শোগুনতন্ত্রকে সমর্থন করেননি। বুদ্ধিজীবীরা জাপানের সাংস্কৃতিক নব জাগরণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁরা বিদ্যাচর্চার সাথে সাথে ওলন্দাজদের মাধ্যমে পাশ্চাত্য দুনিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়েছিলেন। জাপানি বুদ্ধিজীবীরা জাপানকে একটি আধুনিক শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে পরিণত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এইসব বিচক্ষণ বুদ্ধিজীবীরা জানতেন যে, পাশ্চাত্যের সমকক্ষতা অর্জন করতে হলে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানে জাপানকে শিক্ষিত করে তোলা। প্রয়োজন। এর ফলে জাপানের অভ্যন্তরে একদল লোক ক্রমশ জাপানের রুদ্ধ দরজা উন্মুক্ত করে পাশ্চাত্যের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হয়ে পড়েছিল। জাপান এতদিনযে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে ইচ্ছুক ছিল না— পরিস্থিতির চাপে জাপান তার নীতি থেকে সরে এসেছিল। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছিল মার্কিন
(১৮৫৩ সালে কমোডর পেরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি মিলার্ড ফিলমোরের এক পত্র নিয়ে জাপানে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে চারটি যুদ্ধজাহাজ সংবলিত নৌবহর ছিল। এই চিঠিতে রাষ্ট্রপতি জাপানের কাছ থেকে কিছু বাণিজ্যিক সুবিধা ও কয়েকটি জাপানি বন্দরে মার্কিন জাহাজ কর্তৃক কয়লা ও অন্যান্য রসদ পাওয়ার সুবিধা এবং ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অবস্থায় কোনো মার্কিন জাহাজ বা নাবিক যদি উপকূলে এসে উপস্থিত হয়, তবে তারা যাতে ভালো বা সদয় ব্যবহার পায়, তার জন্য দাবি জানিয়েছিলেন। এই চিঠি কমোডর পেরি জাপান কর্তৃপক্ষের হাতে দিয়ে বলেছিলেন যে, তিনি পরের বছর আরও শক্তিশালী নৌবহর নিয়ে এই চিঠির উত্তর নিতে আসবেন। এই এক বছর জাপানি শাসকেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে দেখেন। যে, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত মার্কিন নৌবহরের বিরুদ্ধে তাঁরা কোনো সফল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবেন না। তাই পরের বছর কমোডর পেরি জাপানে এলে জাপান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ১৮৫৪ সালের মার্চ মাসে স্বাক্ষর করেছিল কানাগাওয়া চুক্তি (Treaty of Kanagawa)। এই চুক্তি দ্বারা জাপান তার রুদ্ধ দরজাকে উন্মুক্ত করতে বাধ্য হয়েছিল। এই চুক্তি স্বাক্ষরের পর জাপান অন্যান্য বিদেশি শক্তি যেমন—রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, হলান্ড ইত্যাদি দেশের সঙ্গেও চুক্তিবদ্ধ হতে বাধ্য হয়েছিল। ১৮৫৮ সালে জাপান পুনরায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হ্যারিসের চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়েছিল। এই চুক্তি স্বাক্ষর করে জাপান তার সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নবোধক চিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছিল। জাপানের জনগণ বিদেশিদের কাছে এ ধরনের আত্মসমর্পণকে মানতে পারেনি। তারা বিদেশিদের কাছে নত হওয়ার জন্য শোওনকে ক্ষমা করতে পারেনি। তারা সমগ্র দেশে Son-o-jo-i অর্থাৎ সম্রাটের প্রতি সম্মান দেখাও, বিদেশিদের বিতাড়ন কর এই স্লোগান তুলেছিল। জাপানে বিদেশিবিরোধী দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। এসবের পরিণতিতে শোগুনতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তারা বিদেশিদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি এবং অভ্যন্তরীণ শান্তি বজায় রাখতে পারেনি। নানা কারণে জাপানে যে আর্থিক সংকট ক্রমশ সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল, তাকে মোকাবিলা করতে পারেনি শোগুনতন্ত্র। সকল শ্রেণীর মানুষের মনে শোগুনতন্ত্রের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বিদ্রোহের আকারে প্রকাশ পেয়েছি।এবং অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী হিজেন ও তোসাং (Hizen-and-Tosa) গোষ্ঠী। ১৮৬৭ সালে এই সংঘর্ষ তীব্র আকার ধারণ করেছিল। ওই বছর পূর্বতন শোষনের মৃত্যুর পর তরুণ কেইকি (Keiki) নতুন শোগুন হয়েছিলেন। ওই বছরে জাপানি সম্রাট কামেকি (Kameki) মৃত্যুবরণ করেছিলেন এবং তাঁর স্থলে সম্রাট পদে আসীন হয়েছিলেন মেইজি (Meiji) । কেইকি অনুভব করেছিলেন টোকুগাওয়া গোষ্ঠীর হাতে আর প্রশাসনিক ক্ষমতা ধরে রাখা যাবে না। তাই ১৮৬৭ সালের নভেম্বর মাসে তিনি স্বেচ্ছায় শোগুনের সব ক্ষমতা সম্রাটের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ফলস্বরূপ মিনা মোটো জোরিটোমোর নেতৃত্বে যে শোগুনতন্ত্রের সূচনা হয়েছিল, ১৮৬৭ সালে কেইকির পদত্যাগের মাধ্যমে তার সমাপ্তি ঘটেছিল।
অভ্যন্তরীণ সংকট, আর্থিক দুর্বলতা, কৃষক বিদ্রোহ, বিদেশিদের চাপ, বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিরোধিতা শোগুনতন্ত্রকে দিশেহারা করে দিয়েছিল। শোগুনদের পতনে অভ্যন্তরীণ কারণ বেশি দায়ী না বিদেশিদের চাপ বেশি দায়ী ছিল? এই প্রশ্ন উঠেছে। Sir George Sansom মনে করেন অভ্যন্তরীণ নানা সংকট শোগুনদের পতনের মূল কারণ। জাপানের সকল শ্রেণী শোওনদের শাসনকে মেনে নিতে পারেনি। তারা অপদার্থ শোগুন শাসনের অবসান কামনা করেছিল। ডাইমো, সামুরাই, বণিক, কৃষক, শিক্ষাবিদ সকলেই নানা কারণে শোগুন শাসনের বিরুদ্ধে ছিলেন। G. C. Allen তথ্য দিয়ে দেখিয়েছেন শোগুনতন্ত্রের পতনের পিছনে মূল কারণ ছিল আর্থিক সংকট।
অন্যদিকে Reischauer অভ্যন্তরীণ সংকটকে শোগুনদের পতনের প্রধান কারণ বলে মনে করেন না। তিনি যুক্তি দিয়ে দেখাবার চেষ্টা করেছেন কমোডর পেরির অভিযান ও তার হুমকিকে প্রতিরোধ করতে পারেনি বলে শোগুনতন্ত্র জন সমর্থন হারিয়েছিল। তাঁর মতে বহির্বিশ্বের চাপের জন্যই শোগুনের পতন হয়েছিল। পেরির অভিযান না হলে শোগুনতন্ত্র আরও বেশ কিছুদিন জাপানকে শাসন করত। আর্থিক সংকটকে তিনি গুরুত্ব দেননি। যদি আর্থিক সংকট শোগুনদের পতনের মূল কারণ হত, তাহলে অষ্টাদশ শতকে তাদের পতন হত। অষ্টাদশ শতকে জাপানের আর্থিক অবস্থা একেবারে ভালো ছিল না। উনিশ শতকের মধ্যভাগে শোগুনতন্ত্রের পতন ঘটেছিল, তখন কিন্তু জাপানের আর্থিক অবস্থা খারাপ ছিল না। তাঁর মতে শোওনদের পতনের মূল কারণ কমোডর পেরির অভিযান ও যুদ্ধের হুমকি।
উপসংহারে একথা বলা যায় যে, অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক ও বহির্বিশ্বের জোরে জোরে জোরে ৫ মিলিত গুনতন্ত্রের পতনকে অবশ্যম্ভাবী অংশ। শোগুনদের পতনে সকল শ্রেণিও বিক্ষুব্ধ মনোভাব কার্যকর ছিল। ঐতিহাসিক হল পাসে শোগুনদের পতনে সামুরাই শ্রেণির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু মনে রাখতে হবে কেবলমাত্র সামুরাই শ্রেণীর জন্যই শোগুনদের পতন হয়নি। সমস্ত শ্রেণী বিক্ষুব্ধতার রূপান্তর হল শোগুনতন্ত্রের পতন এবং মেজি রেস্টোরেশনের উত্থান।
একমাত্র কারণের ফলশ্রুতিতে পালাবদলের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। সম্রাট তাদের হাতে সমস্ত শক্তি প্রয়োগের জন্য বিক্ষুব্ধ জনতার সাথে শোগুনতন্ত্রের সমর্থকদের প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল। শোগুনদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে জাপানের চারটি সামস্ত সদস্য মুখ্য ভূমিকা পালন করা। এরা হলপূর্ণভাবে প্রবল প্রবল সাংসুমা (সাতসুমা) ও চোসু (চোসু) কাউন্সিল।
(মেইজি রেষ্টরেশন এর পটভূমি পড়তে হলে এই লিংকে ক্লিক করুন)
***** আপনার মূল্যবান সময়টি দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। ইতিহাস সহ আরো অন্যান্য বিষয়ের উপর টপিক পড়তে হলে আমাদের সাইটের ভিজিট করুন।***
ইতিহাসসহ অন্যান্য যেকোনো বিষয়ের উপর নোট পেতে চাইলে আমাকে কমেন্ট করুন। আমি আপনাদের সেই বিষয়ের উপর নোট দিতে সাহায্য করবো। ধন্যবাদ
0 Comments
If you like the posts, you must comment. and if there is any problem , please let me know in the comments.