চীনের বক্সার যুদ্ধের প্রকৃতির বর্ণনা করো।
বক্সার অভ্যুত্থানের প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিক বিতর্ক আছে। ঐতিহাসিকগণ বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে আন্দোলনের প্রকৃতিকে বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকেরা বক্সার অভ্যুত্থানকে সাধারণত 'বক্সার বিদ্রোহ' বলে থাকেন। দক্ষিণ চীনের তখনকার প্রাদেশিক শাসকেরা তাদের শাসিত এলাকাকে বক্সার আন্দোলন এবং এর বিরুদ্ধে পরিচালিত বিদেশি অভিযানের হাত থেকে মুক্ত রাখার জন্য তাঁরাও এই আন্দেলনকে 'বিদ্রোহ' বলে অভিহিত করেছেন। তাঁরা দাবি করেছিলেন যেহেতু এটা ‘বিদ্রোহ’ তাই বিদেশি সৈন্যদের এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। দক্ষিণ চীনকে বক্সারআন্দোলনের হাত থেকে মুক্ত রাখার জন্য বিদেশি শক্তিগুলোও তাদের এই দাবিকে মেনে নিয়েছিল।
কিন্তু এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে বক্সার অভ্যুত্থানকে কি 'বিদ্রোহ' বলা সঠিক? 'বিদ্রোহ' বলতে বোঝায় দেশের প্রতিষ্ঠিত রাজশক্তি বা সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী বিচার করলে বক্সার আন্দোলনকে কি 'বিদ্রোহ' বলা চলে? বক্সার অভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনকারীরা বিদেশি শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তুলেছিল। কিন্তু সে সময়ে চীনে আইনসংগত শাসক ছিল মাঞ্চু রাজারা। আন্দোলনকারীরা তো মাঞ্চু শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেনি। তাই এই আন্দোলনকে 'বিদ্রোহ' আখ্যা দেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়।
তাহলে এই আন্দোলনের প্রকৃতিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে? বক্সার আন্দোলনকারীরা দেশপ্রেমের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহকে চীন থেকে উৎখাত করতে চেয়েছিল এবং একই সাথে তারা সমস্ত পাশ্চাত্য চিন্তাধারাকেও বিতাড়িত করতে চেয়েছিল। জ্যাক প্রে-র মতে বিদ্রোহীদের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিদেশিদের চীন থেকে বিতাড়িত করা। অনেকে তাই এই বিদ্রোহকে দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদীদের আন্দোলন বলে বর্ণনা করেছে।
ঐতিহাসিক জ্যা শোনোর মতে এই আন্দোলন ছিল খ্রিস্টান মিশনারি ও ধর্মান্তরিত চীনা খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে জেহাদ। মূলত খ্রিস্টধর্মের বিরোধিতাই ছিল এই আন্দোলনের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। আন্দোলনকারীগণ খ্রিস্টান মিশনারিদের হত্যা করেছিল। গির্জা ও ইউরোপীয়দের আবাসস্থলে অগ্নিসংযোগ করেছিল। এগুলি সবই ছিল তাদের খ্রিস্টধর্মের বিরোধিতার বহিঃপ্রকাশ। চীনাদের কাছে খ্রিস্টধর্মের কোনো মূল্য ছিল না। তারা এই ধর্মকে চূড়ান্তভাবে বর্জন করেছিল। চীনাদের কাছে খ্রিস্টধর্ম ছিল গোঁড়া ও রক্ষণশীল। স্বাভাবিক কারণে তাদের কাছে এই ধর্ম গ্রহণযোগ্য ছিল না। তারা খ্রিস্টান ধর্মকে চূড়ান্তভাবে বর্জন করেছিল। বিদ্রোহীরা প্রচার করেছিল চীনের দুর্দশার জন্য বিদেশি খ্রিস্টানরা দায়ী। ১৯০০ সালে চীনে যে খরা হয়েছে তা হল বিদেশিদের পাপের ফল। বিদেশিরা চীন থেকে চলে গেলে আবার চীনে বৃষ্টি হবে, নদীতে বান আসবে। বিদ্রোহীরা আরও প্রচার করেছিল, খ্রিস্টান ধর্ম চীনের দেবতাদের বঞ্চনা করেছে, চীনের সাধুসন্তদের প্রতি সাধারণ মানুষের যে বিশ্বাস ছিল তাকে নষ্ট করে দিয়েছে। বুদ্ধের বাণী খ্রিস্টানদের জন্য অবহেলিত হয়েছে। এজন্যই চীনে খরা দুর্ভিক্ষ বেড়েছে। এটা ঠিক যে ১৮৬০ সালের পর চীনে ক্যাথলিক চার্চের প্রভাব বেড়েছিল। চার্চগুলো বিশাল সম্পত্তির মালিকে পরিণত হয়েছিল। চার্চগুলো ছিল দুর্ভেদ্য দুর্গের মতো। চীনের স্থাপত্যের সঙ্গে কোনো মিল ছিল না। এসব কারণে চীনাদের সঙ্গে খ্রিস্টানদের সম্পর্ক নষ্ট হয়েছিল। খ্রিস্টানরা সমাজ সংস্কারের কাজ করতে গিয়ে বিশেষ করে ধূমপান, মদ্যপান নিষিদ্ধ করতে গিয়ে সাধারণ চীনাদের কাছে বিরাগভাজন হয়েছিল। কিন্তু জি.এন. স্টাইগারেরমতো পণ্ডিতগণ মনে করেন যে আন্দোলনকারীগণ প্রকৃতপক্ষে খ্রিস্টধর্মের বিরোধী ছিলেন না। কারণ ধর্মীয় বিদ্বেষ চীনের ঐতিহ্যের সঙ্গে মানানসই ছিল না। এছাড়াও অনেকে মনে করেন যে চীনে খ্রিস্টান ধর্মের ভূমিকা ছিল গৌরবময় ও সৃজনশীল। খ্রিস্টানদের মাধ্যমে চীনারা পশ্চিমি সভ্যতার সংস্পর্শে এসেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাস্তবে দেখা যায় যে চীনারা খ্রিস্টধর্ম ও মিশনারিদের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত ছিল। খ্রিস্টান মিশনারিরা চীনের প্রচলিত কনফুসীয়, তাও এবং বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়েছিল। তাদের বক্তব্য ছিল খ্রিস্টধর্ম চীনের ধর্মের থেকে অনেক ভালো। তারা জোর করে চীনাদের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করেছিল। তাদের আচরণ চীনাদের মনে বিদেশি বিরোধিতার জন্ম দিয়েছিল। ফেয়ারব্যাঙ্কের মতে চীনের জনজীবনে যে গভীর সংকট দেখা দিয়েছিল বক্সার বিদ্রোহ ছিল তার বিরুদ্ধে এক প্রত্যক্ষ সংগ্রাম।
এই আন্দোলনের প্রকৃতি বিশ্লেষণ প্রখ্যাত ভারতীয় বিপ্লবী M. N. Roy করেছেন। তাঁর মতে বক্সার অভ্যুত্থান চীনের সামন্ততান্ত্রিক শোষণের এবং অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট এবং দরিদ্রতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম ছিল। সাধারণ কৃষকশ্রেণীও এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিল। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেছেন এই আন্দোলনের সাথে মাঞ্চু রাজবংশের সম্পর্ককে এক আকস্মিক ঘটনা বলে অভিহিত করা যায়। অর্থাৎ তাঁর মতে এই আন্দোলনে মাঞ্চু শাসকদের ভূমিকা ছিল না।
চীনা কমিউনিস্টদের মতে এই আন্দোলন প্রকৃতিগত দিক দিয়ে ছিল কৃষক আন্দোলন। ১৯৬০ সালে বক্সার আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী যেসব মানুষ তখনও বেঁচেছিলেন তাদেরকে নিয়ে একটি সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। তাতে দেখা গিয়েছিল বিদ্রোহীদের সত্তর শতাংশের বেশি মানুষ এসেছিলেন দরিদ্র কৃষক পরিবার থেকে। কিন্তু বিদ্রোহীদের অন্ধ বিদেশি বিরোধিতার জন্য এই বিদ্রোহ সামন্ত্রতন্ত্র বিরোধী সংগ্রামে রূপ নিতে পারে
অনেকেরই বক্তব্য হল এই আন্দোলন ছিল গণ-আন্দোলন। কৃষক, শ্রমিক, নৌকার মাঝি, ফেরিওয়ালা, কর্মহীন মানুষ, হস্ত শিল্পী, ছোটো দোকানদার, কুটির শিল্পী প্রমুখ অংশ নিয়েছিলেন। এই আন্দোলনে চীনা নারীদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
অনেকেই যেমন হবসবম মনে করেছেন এই আন্দোলন ছিল সামাজিক আন্দোলন। এই আন্দোলনে রবিনহুড সুলভ ডাকাতি, গ্রাম্য গুপ্ত সংস্থা ও প্রাক-শিল্পায়ন শহুরে দাঙ্গার সংমিশ্রণ ঘটেছিল। তাইপিং বিদ্রোহীদের মতো এদের কোনো সামাজিক কর্মসূচি ছিল না। তারা কৃষিজীবী হলেও ভূমি সংস্কার বিষয়ে তাদের কোনো চিন্তাধারা ছিল না। অনেক পাশ্চাত্য পণ্ডিত এই আন্দোলনকে একটি ‘প্রতিক্রিয়াশীল' আন্দোলন বলেই মনে করে থাকেন। কিন্তু এই আন্দোলনকে ‘প্রতিক্রিয়াশীল' আন্দোলন বলা বোধহয় ঠিক নয়। আন্দোলনকারীরা দেশেপ্রেমের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বিদেশিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিল। এই আন্দোলন ছিল সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলন। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাদের ভূমিকা ছিল উজ্জ্বল। বলশেভিক নেতা লেনিন এই আন্দোলনের প্রশংসা করেছিলেন। মার্কিন ঔপন্যাসিক মার্ক টোয়েন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে বক্সারদের আন্দোলনকে অভিনন্দিত করেছেন।
বক্সার আন্দোলনকে পর্যালোচনা করে ঐতিহাসিক জেরোমে চিন (Jerome Chin) একে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন। প্রথম পর্যায়ে তারা বিদেশিদের বিরুদ্ধে তাদের ঘৃণা প্রকাশের সাথে সাথে মাঞ্চু শাসনের বিরুদ্ধে তাদের চাপা বিক্ষোভ প্রকাশ করেছিল। আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে যখন আন্দোলনকারীরা মাঞ্চু সৈনিকদের কাছে পরাজিত হয়েছিল তখন তারা মাঞ্চু শাসনের সমর্থনে এবং বিদেশিদের বিরুদ্ধে শ্লোগান তুলেছিল। কিন্তু তারা কিছুদিন পর বুঝেছিল দুর্নীতিগ্রস্ত মাঞ্চু দরবারের কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাওয়া যাবে না। তাই আন্দোলনের তৃতীয় পর্যায়ে অভ্যুত্থানকারীরা জনগণকে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মচারীদের হাত থেকে রক্ষা করার কথা বলেছিল। জেরোমে চিনের সিদ্ধান্ত হল বক্সার অভ্যুত্থানকারীরা মাঞ্চু সরকারের সাথে হাত মেলালেও তারা কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বরাবরই মাঞ্চু-বিরোধী ছিল। তাদের এই আন্দোলনকে মাক্তুদের পক্ষাবলম্বী বলা চলে না।
বিভিন্ন তথ্যের বিচার বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে এই আন্দোলন ছিল বিদেশি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এবং খ্রিস্টধর্ম ও সমস্ত বিদেশি ভাবধারার বিরুদ্ধে এক বিরাট গণ-আন্দোলন। এই আন্দোলনে কৃষক, শ্রমিক, ভবঘুরে, ফেরিওয়ালা, কুলি, হস্তশিল্পী এবং জীবন যুদ্ধে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। চীনা নারীরা ঐতিহ্যের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে এই আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। তাদের কতকগুলো পর্যায় ছিল। ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী মেয়েরা লাল লণ্ঠন বাহিনীর সদস্য ছিলেন। মধ্যবয়সী গৃহবধূরা নীল লণ্ঠনের, বয়স্কা নারীরা কালো লণ্ঠন এবং বিধবারা সবুজ লণ্ঠনের সদস্য ছিলেন। এই গণ-আন্দোলনে মাঞ্চু অপশাসনের বিরুদ্ধে এক চাপা বিক্ষোভও লক্ষ করা যায়। এই আন্দোলনকে চীনের খোলা দরজা বন্ধ করার শেষ ব্যর্থ প্রয়াস বলেও অভিহিত করা যায়। কিন্তু এই আন্দোলনকে কোনোভাবেই ‘বিদ্রোহ' আখ্যা দেওয়া যায় না।
0 Comments
If you like the posts, you must comment. and if there is any problem , please let me know in the comments.