ক্যান্টন বাণিজ্য | ক্যান্টন বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য ও অবসানের কারণ | ক্যান্টন বাণিজ্যের গুরুত্ব ও ফলাফল |
চীন বিদেশিদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। কিন্তু বিদেশি বণিকেরা চীনের বিশাল বাজারকে তাদের বাণিজ্যের স্বার্থে কাজেলাগাবার জন্য মরিয়া প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়ে চীনা সম্রাট বিদেশিদের ক্যান্টন বন্দরে বাণিজ্য করার সুযোগ দিয়েছিল। ক্যান্টন বন্দর ছিল দক্ষিণ চীনে অবস্থিত। অবশ্য Tang যুগ (৬১৮-৯০৭) থেকেই এই বন্দর বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। এই বন্দরে প্রথম হাজির হয়েছিল পর্তুগিজ বণিকরা। উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে ভারতে আসার সমুদ্রপথ আবিষ্কৃত হওয়ার পর ১৫১৭ সাল নাগাদ পর্তুগিজ বণিকরা ক্যান্টন বন্দরে এসেছিল। পর্তুগিজের চীনা কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে ক্যান্টনের নিকটবর্তী ম্যাকাওতে বাণিজ্য বিস্তারের চেষ্টা করেছিল। তারা অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকদের ক্যান্টনে প্রবেশে বাধার সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু পর্তুগিজদের বাধা কার্যকর হয়নি। কারণ অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকরা যেমন ইংরেজ, ওলন্দাজ ও ফরাসিগণ ক্যান্টনে এসে উপস্থিত হয়েছিল।
দূর প্রাচ্যে বাণিজ্য করার জন্য ষোড়শ শতাব্দীতে ইংরাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রানি এলিজাবেথের কাছ থেকে একচেটিয়া বাণিজ্য করার অধিকার পেয়েছিল। ১৬৩২ সালে ক্যাপটেন ওয়েডেলার (Captain Weddell) নেতৃত্বে একটি বণিক দল ক্যান্টনে এসে উপস্থিত হয়েছিল। তারা জোর করে সেখানে বাণিজ্য করার চেষ্টা করেছিল। শুধু তাই নয় এ্যাময় (Amoy) এবং নিংপোতে (Ningpo) তারা বাণিজ্য বিস্তারে উদ্যোগ নিয়েছিল। ১৭৫৯ সালে জেমস ফ্লিট নামে এক ইংরেজ বণিক নিংপোতে বাণিজ্যে বাধা পেয়ে সে আদালতের দারস্থ হয়েছিল। এইসব ঘটনা চীনা সরকারকে বিরক্ত করেছিল। সরকার এই নির্দেশ দিয়েছিল যে বিদেশিরা একমাত্র ক্যান্টন ছাড়া চীনের অন্য কোথাও বাণিজ্য করতে পারবে না। এই নির্দেশ ১৮৪২ সালের নানকিং চুক্তি পর্যন্ত কার্যকর হয়েছি
ক্যান্টন বাণিজ্যে বিদেশিদের বেশ প্রতিকূলতার মধ্যে এবং সমঝোতা করে বাণিজ্য করতে হয়েছিল। অথচ অন্যান্য দেশে বিদেশি বাণিজ্যের প্রতি আগ্রহ থাকে এবং তারা দেশের আর্থিক উন্নয়নের জন্য বিদেশি বাণিজ্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কিন্তু চীন ছিল তার ব্যতিক্রম। কনফুসীয় দর্শনে বিশ্বাসী চীনা সমাজে বাণিজ্যের তেমন গুরুত্ব ছিল না। তাই চীনাবাসীদের কাছে বিদেশি বণিকরা ছিল। অবাঞ্ছিত। চীনারা নিজেদের অতি শ্রেষ্ঠ ও সভ্য বলে মনে করত সেজন্য তারা বিদেশি বণিকদের তাদের সমপর্যায়ভুক্ত বলে মনে করত না। তারা বিদেশিদের ওপর নানাবিধ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল। তাদের বক্তব্য ছিল চীনারা বিদেশিদের কৃপা করে বাণিজ্য করার অধিকার দিয়েছে
ক্যান্টন বাণিজ্যের মাধ্যমে চীনা সরকার বিদেশিদের ওপর অনেক বাধানিষেধ আরোপ করেছিল। বিদেশিদের ক্যান্টন ছাড়া অন্য কোনো চীনা বন্দরে বাণিজ্যের অধিকার দেওয়া হয়নি। এমনকি ক্যান্টনেও বিদেশিরা নিজেদের ইচ্ছামতো বাণিজ্য। করতে পারত না। তাদের কো হং (Co-Hung) নামক বাণিজ্য সংস্থার মাধ্যমে বাণিজ্য করতে হত। ক্যান্টন শহরে কতকগুলো চীনা বাণিজ্যিক সংস্থা একত্রিত হয়ে কো-হং নামে একটি সংগঠন তৈরি করেছিল। কো-হং সংস্থার সদস্যদের 'হং' বলা হত। ক্যান্টনের আবগারি অধিকর্তাকে বলা হত হপ্পো (Hoppo)। বিদেশি বণিকদের ক্যান্টনে বাণিজ্য করার জন্য হপ্পোর কাছে আবেদন করতে হত। তারা ছিল আকণ্ঠ দুর্নীতিপরায়ণ।
ক্যান্টন বাণিজ্যে 'হং'-দের অপ্রতিহত প্রাধান্য ছিল। হং বণিকদের মাধ্যমেই বিদেশিরা বাণিজ্য করতে বাধ্য ছিল। হং বণিকদের কাছে বিদেশিরা তাদের পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করত। হং বণিকদের এই একচেটিয়া প্রাধান্য স্বাভাবিক কারণে বিদেশিদের কাছে অভিপ্রেত ছিল না। সুযোগ বুঝে হং বণিকরা বিদেশিদের শোষণ করত। ক্যান্টন বাণিজ্যের মাধ্যমে তারা প্রচুর মুনাফা অর্জন করেছিল। তারা বিদেশিদের কাছে কম দামে পণ্য কিনত এবং তাদের কাছে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করত। বিদেশিদের কাছে তারা উৎকোচ গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল না। ঐতিহাসিক জ্যা শোনোর (Jean Chesneaux) মতে হং বণিকরা ক্যান্টনে বিশেষ অবস্থার সুযোগ নিয়ে অসম্ভব প্রতাপশালী হয়ে পড়েছিল। এর পরিণামে চীনে একধরনের 'বণিক অভিজাততন্ত্র' বা Trading Aristocracy তৈরি হয়েছিল। অবশ্য এটা ঠিক যে পরিস্থিতি হং বণিকদের দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠতে বাধ্য করেছিল। কারণ একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার ধরে রাখার জন্য তাদের চীনা রাজদরবারে এবং হপ্পোকে প্রচুর অর্থ উৎকোচ প্রদান করতে হত। হং বণিকরাই ছিল ক্যান্টন বাণিজ্যের প্রধান পরিচালক। বিদেশি বণিকেরা তাদের কাছে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ে বাধ্য ছিল, এমনকি হং বণিকদের মাধ্যমে তারা স্থানীয় প্রশাসন ও রাজদরবারের সঙ্গে যোগাযোগ করত। সব ক্ষেত্রেই বিদেশিদের হং বণিকদের অর্থ দিতে হত। সমস্ত চিঠিপত্র, আবেদনপত্র, এমনকি হৎ বণিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও তাদের মাধ্যমে করতে হত। হং বণিকদের কাছে বিদেশি বণিকেরা ছিল দয়ার পাত্র। হং বণিকদের অঙ্গুলি হেলনেই ক্যান্টন বাণিজ্য চলত।
ক্যান্টন বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বিদেশি বণিকদের ওপর বহু বাধা নিষেধ চীনা সরকার আরোপ করেছিল। বাণিজ্য কুঠিতে বিদেশিনী মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। বিদেশি বণিকদের স্বাধীনভাবে নৌকা বিহারের অধিকার ছিল না। বিদেশিরা চীনা ভাষা শেখার অধিকার পায়নি। চীনা আইনের প্রয়োগ ও বাধ্যবাধকতা বিদেশিদের কাছে অসহনীয় ছিল। কোনো বিদেশি বণিক চীনা আইন ভাঙলে বা অপরাধ করলে তাকে চীনা কর্তৃপক্ষের কাছে হাজির করানোর দায়িত্ব ছিল তার ঊর্ধ্বতন আধিকারিকের। তিনি যদি সেই দায়িত্ব পালনে অক্ষম হতেন তাহলে চীনা কর্তৃপক্ষ অপরাধীর পরিবর্তে আধিকারিককে শাস্তি দিত। এই ধরনের অদ্ভুত আইনও বিচার পদ্ধতি বিদেশিরা মানতে চায়নি। তাদের মনে চীনাদের সম্পর্কে অসন্তোষ ক্রমশই বেড়েছিল।
ক্যান্টন বাণিজ্যে বিদেশিদের মধ্যে ইংরেজদের প্রাধান্য ছিল বেশি। ব্যক্তিগত ব্যবসা বা Private Trade-এর মাধ্যমে তারা বাণিজ্য পরিচালনা করত। ব্যক্তিগত মালিকানাভুক্ত জাহাজ এই বাণিজ্যে প্রধান ছিল। ব্যক্তিগত ব্যবসাকে বলা হত Country Trade এবং বাণিজ্য জাহাজগুলোকে বলা হত Country Ship. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের বেতন কম ছিল। তাই কোম্পানির কর্তৃপক্ষ কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের অধিকার দিয়েছিল। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে ক্যান্টন, ভারত ও ইংল্যান্ডের মধ্যে বাণিজ্য দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই বাণিজ্য বৃদ্ধির মূল কারণ ছিল চীনে উৎপাদিত চা-এর জন্য ইংল্যান্ডের চাহিদা এবং ভারতে উৎপাদিত তুলা ও আফিং-এর জন্য চীনের চাহিদা। ইংল্যান্ড ক্যান্টন বন্দরের মাধ্যমে চীন থেকে আমদানি করত চা, রেশম, চীনামাটির বাসন, দারুচিনি ইত্যাদি। চীনে রপ্তানি করত পশমজাত দ্রব্য, সীসা, টিন, লোহা, তামা, পশুর লোম, নানাবিধ খেলনা ইত্যাদি। ইংল্যান্ড ভারতে রপ্তানি করত কার্পাস বস্ত্র, ফিটকিরি, কর্পূর, গোলমরিচ, লংকা, সিন্দুর, মিছরি, ওষুধ ইত্যাদি। ভারত থেকে আমদানি করত তুলা, আফিং, রূপা, চন্দন কাঠ, হাতির দাঁত ইত্যাদি।
ইংল্যান্ডের বাজারে চীনের উৎপাদিত চা-এর ছিল ভালো চাহিদা। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ১৬৮৪ সাল নাগাদ ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্যান্টন থেকে বছরে ৫ থেকে ৬ পেটি চা কিনেছিল। সাধারণত এক পেটিতে ১৩৩ পাউন্ড চা থাকত। অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে ইংল্যান্ড বছরে ৪০০,০০০ পাউন্ড চা চীন থেকে কিনেছিল। ইউরোপের দেশগুলোতে চা-এর চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পেলে চা আমদানির জন্য ক্যান্টন বন্দরে বিদেশি বাণিজ্য জাহাজের ভিড় লেগে যেত। ১৭৫১ সালে ক্যান্টন বন্দরে যেখানে বিদেশি বাণিজ্যের জাহাজের সংখ্যা ছিল ১৯টি সেখানে ১৭৮৭ সালে জাহাজের সংখ্যা ছিল ৮১টি। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে চীনে আমেরিকা বাণিজ্যের জন্য উপস্থিত হয়েছিল। আমেরিকার বাণিজ্য জাহাজ 'Em press of China' নিউ ইয়র্ক থেকে ১৭৮৪ সালে চীনে এসে উপস্থিত হয়েছিল। ইংল্যান্ডের সাথে আমেরিকার বাণিজ্যের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য ছিল। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল একচেটিয়া বাণিজ্যের পৃষ্ঠপোষক। অন্যদিকে মার্কিনরা ছিল অবাধ বাণিজ্য নীতির সমর্থ
স্বাভাবিকভাবে দেখা যায় যে ক্যান্টন বাণিজ্যের প্রকৃতি ছিল চীনের অনুকূলে এবং বিদেশিদের প্রতিকূলে। বিদেশিদের কোনো পণ্য সাধারণত চীনারা কিনতে চাইত না। চীনে কোনো নির্দিষ্ট বাণিজ্যিক শুল্ক ছিল না। ক্যান্টন বাণিজ্য চলত হংক।।বণিকদের ইচ্ছানুযায়ী। পাশ্চাত্য বণিকরা বিশেষ করে ইংল্যান্ডের বণিকেরা চীন থেকে চা, সিল্ক, মসলিনজাত দ্রব্য কিনত। কিন্তু তার বিনিময়ে চীনে যথেষ্ট পণ্য তারা বিক্রি করতে পারত না। ফলে ইংল্যান্ড থেকে প্রচুর সোনা ও রূপা চলে। এসেছিল। চীনাদের বিশ্বাস ছিল পাশ্চাত্য দেশগুলো তাদের পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। বিদেশের বাজারে চীনা পণ্যের চাহিদা ছিল। এককথায় বলা যায় যে ক্যান্টন বাণিজ্যের ভারসাম্য ছিল চীনাদের পক্ষে।
ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথায় চীনারা closed door policy বা রুদ্ধদ্বার নীতি অনুসরণ করেছিল। চীনারা নিজেদের সুসভ্য জাতি এবং বিদেশিদের অসভ্য বলে মনে করত। ক্যান্টন বাণিজ্যকে পরিচালনার জন্য বিদেশিরা অর্থাৎ ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, সুইডেন, ডেনমার্ক, স্পেন ইত্যাদি দেশগুলো হং বণিকদের কাছ থেকে বছরে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে বাণিজ্য কুঠি ভাড়া নিত। হং বণিকরা পার্ল নদীর তীরে এই বাণিজ্য কুঠিগুলো নির্মাণ করেছিলেন। বিদেশি বণিকরা এই কুঠিগুলোর মাধ্যমে ক্যান্টন বাণিজ্য পরিচালনা করত। চীনারা এই বাণিজ্য কুঠিগুলোকে “বর্বরদের সংস্থা” বলে উপহাস করত। বিদেশিদের প্রতি অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যপূর্ণ মনোভাব ক্যান্টন বাণিজ্যকে প্রভাবিত করেছিল। আধুনিক কালের অনেক ঐতিহাসিক ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথায় closed door policy কার্যকর হয়েছিল বলে মনে করেন না। তাঁরা মনে করেন এই বাণিজ্যে চীনারা বিদেশিদের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছিল। জ্যাঁ শোনো এই মতকে সমর্থন করেছেন।
বিদেশিদের ওপর ক্যান্টন বাণিজ্যে চীনা কর্তৃপক্ষ বহু নিয়ন্ত্রণ জারি করেছিল। তাদের অনেক অসুবিধার মধ্যে বাণিজ্য করতে হত। তাই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে যে এত বাণিজ্যের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিদেশি বণিকেরা বিশেষ করে ইংল্যান্ড কেন চীনের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছিল? উত্তরে বলা যায় : (ক) ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব এর পিছনে মূল কারণ ছিল। ইংল্যান্ডের পুঁজিপতি ও বণিকেরা চীনের বিশাল বাজারে তাদের শিল্পজাত পণ্য বিক্রি করার চেষ্টা করেছিল। (খ) অষ্টাদশ শতকের শেষ দশকে ফরাসি বিপ্লবের ফলে ইউরোপের বাজারে ব্রিটিশ শিল্পজাত পণ্য বিক্রির পথে অনেক বাধার সৃষ্টি হয়েছিল। তাই ইংল্যান্ডের পক্ষে ভালো বাজার প্রয়োজন ছিল। বিশাল চীন তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে বলে মনে হয়েছিল। সেজন্য ক্যান্টন বাণিজ্যে এত বাধা সত্ত্বেও চীনের সাথে বাণিজ্য চালিয়ে গিয়েছিল। (গ) নানা বাধা সত্ত্বেও ক্যান্টন বাণিজ্য বিদেশিদের কাছে বেশ আকর্ষণীয় ও লাভজনক ছিল। বিদেশিরা বিশেষ করে ইংল্যান্ড এই লাভজনক বাণিজ্যকে হাতছাড়া করার মতো বোকা ছিল না। বরং শক্তিশালী ইংল্যান্ড তাদের বাণিজ্যের পথে বাধা অপসারণের জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা আরম্ভ করেছিল এবং তারা সফল হয়েছিল।
ক্যান্টন বাণিজ্যের পতনের কারণ:
ক্যান্টন বাণিজ্যের পতনের কারণ প্রথম :
প্রথম থেকেই বিদেশিরা ক্যান্টন বাণিজ্যের ওপরে চীনাদের মাত্রাতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণকে মানতে পারেনি। বিদেশিরা ক্যান্টন ছাড়া অন্য কোথাও বাণিজ্যের অধিকার পায়নি। বিদেশিদের ব্যক্তিগত জীবনেও চীনা কর্তৃপক্ষ বহু ধরনের অমূলক বাধানিষেধ আরোপ করেছিল। এই ধরনের বাধানিষেধ ও নিয়ন্ত্রণকে বিদেশিরা বিশেষ করে শক্তিশালী ইংল্যান্ডের বণিককুল মানতে পারেনি। চীনারা নিজেদের সুসভ্য বলে মনে করত। তারা ইংরেজ বণিকসহ সমস্ত পাশ্চাত্য বণিকদের অত্যন্ত খারাপ চোখে দেখত। পাশ্চাত্য বণিকরা চীনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারত না। তারা নজরানা প্রথা ও কাওটাও প্রথা মানতে পারেনি। অনেকের মতে কাওটাও প্রথা ও চীনা রাজকর্মচারীদের খারাপ ব্যবহার ছিল পাশ্চাত্য বণিকদের সাথে চীনাদের তিক্ত ব্যবহারের মূল কারণ।
ক্যান্টন বাণিজ্যের পতনের কারণ দ্বিতীয়:
ক্যান্টন বাণিজ্য পরিচালনা করত হং বণিকরা। তারা ছিল দুর্নীতিপরায়ণ। তাদের চাপানো শর্তে বিদেশিদের বাণিজ্য করতে হত। তারা যে পণ্যমূল্য নির্ধারণ করে দিত তাকে বিদেশিরা মেনে চলতে বাধ্য হত। হং বণিকদের মাধ্যমে বিদেশিদের পণ্য ক্রয়-বিক্রয় হত। হং বণিকরা বিদেশিদের কাছ থেকে বাণিজ্যের জন্য প্রচুর অর্থ উৎকোচ স্বরূপ গ্রহণ করত। ক্যান্টন বাণিজ্যে হং বণিকদের আচরণ বিদেশিদের ক্ষুব্ধ করেছিল। ক্যান্টন বাণিজ্যের অবসানে হং বণিকদের দুর্নীতি বিশেষভাবে যে দায়ী ছিল তা বলাই বাহুল্য।
ক্যান্টন বাণিজ্যের পতনের কারণ তৃতীয় :
ক্যান্টন বাণিজ্যের অহেতুক বিধিনিষেধগুলো বিদেশিরা মানতে চায়নি। ক্যান্টনে বাণিজারত বণিকদের চীনা আইনে বিচার করা হত। চীনা আইন ছিল খুবই কঠোর। বিশেষ করে ফৌজদারি আইন। শান্তিদান ছিল মধ্যযুগীয়। স্বভাবতই বিদেশিরা চীনা আইনের হাত থেকে মুক্তি দাবি করেছিল। কিন্তু বিদেশিদের কোনো দাবিকে চীনা কর্তৃপক্ষ মানতে রাজি ছিল না। চীনের বক্তব্য ছিল, বিদেশিদের চীনে আগমন অবাঞ্ছিত। চীনে বিদেশি পণ্যের কোনো দরকার নেই। এই অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য চীনকে দিতে হচ্ছে মহামূল্যবান চা। এতেও যখন বিদেশিরা চীনে খুশি মনে থাকতে নারাজ, তখন তাদের এই দেশে না থাকাই ভালো। চীনা কর্তৃপক্ষ ক্যান্টন বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ সামান্যতম শিথিল করতে রাজি ছিল না। বরং তারা সবসময় বিদেশিদের সঙ্গে ব্যবসা বন্ধ করার হুমকি দিত। স্বাভাবিক কারণে বিদেশি বণিকদের সঙ্গে চীনা কর্তৃপক্ষের মতভেদ ক্রমশ বেড়েছিল। উভয়পক্ষের মধ্যে তিক্ত সম্পর্ক ক্যান্টন বাণিজ্যের পতনের অন্যতম কারণ ছিল তা বলাই বাহুল্য।
ক্যান্টন বাণিজ্যের পতনের কারণ চতুর্থ :
ক্যান্টন বাণিজ্যে ইংরেজ বণিকদের প্রাধান্য ছিল অন্য বিদেশি বণিকদের তুলনায় বেশি। তারা প্রথম থেকেই ক্যান্টন বাণিজ্যের ওপরে চীনাদের অন্যায় বাধানিষেধমানতে পারেনি। বাধানিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ ইংরেজ বণিকরা নানা কারণে নানা অজুহাতে চীনাদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়ত। উদাহরণ দিয়ে বলা যায় যে ১৭৮৪ সালে Lady Hughes-কে কেন্দ্র করে ক্যান্টনে ইংরেজ বণিক এবং চীনাদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়েছিল। ১৭৮৪ সালের ১৭ নভেম্বর ওই জাহাজ থেকে তোপধ্বনি হওয়ার সময় দুজন চীনা কর্মচারী গোলন্দাজদের ভুলে প্রাণ হারিয়েছিলেন। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়াতে ক্যান্টনে অশান্তি সৃষ্টি হয়েছিল। দোষী গোলন্দাজকে চীনারা হত্যা করেছিল। স্বভাবতই এই ঘটনায় ইংরেজরা বিব্রত হয়ে পড়েছিল এবং নিজেদের ভবিষ্যত নিরাপত্তা সম্বন্ধে চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। এছাড়াও নানা কারণে ইংরেজরা চীনাদের প্রতি বিরক্ত ছিল। অসম বাণিজ্য, বাণিজ্যের ওপর কঠোর বাধানিষেধ, উপঢৌকন প্রদান, মধ্যযুগীয় চীনা আইনের প্রয়োগ ইত্যাদির জন্য ইংরেজ বণিকেরা নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাত। ইঙ্গ-চীন সম্পর্ককে ভালো করার জন্য কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ওপর ইংরেজ কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দিয়েছিল। চীনের সাথে ব্যবসাবাণিজ্যের প্রয়োজনীয়তার ওপরে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দিয়েছিল। ১৭৮৭ সালে ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথার কঠোরতা লাঘবের জন্য এবং চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ইংরেজ সরকার কর্নেল চার্লস ক্যাথকাটকে পিকিং দরবারে ব্রিটিশদের প্রতিনিধি হিসাবে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু চীন যাওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হলে এই মিশনের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছিল। ১৭৯২ সালে ব্রিটিশ সরকার একই উদ্দেশ্যে লর্ড ম্যাকআর্টনিকে চীনে পাঠিয়েছিলেন। তিনি চীনে ভালো অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর আসল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়েছিল। তিনি চীনা সম্রাটকে ইঙ্গ-চীন বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য কতকগুলো প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। এগুলি হল : ক্যান্টন ছাড়াও ব্রিটিশ বাণিজ্যের সম্প্রসারণ করতে হবে, পিকিং শহরে ব্রিটিশ পণ্য বিক্রির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, ব্রিটিশ বণিকদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে, নিয়ম বহির্ভূত বাণিজ্য শুল্ক আদায় বন্ধ করতে হবে, শুল্ক নীতির প্রতিলিপি ব্রিটিশ বণিকদের দিতে হবে। ম্যাকআর্টনির এই প্রস্তাব স্বাভাবিকভাবে চীনা সম্রাট অগ্রাহ্য করেছিলেন। কেবল তাই নয় চীনা সম্রাট চিয়েন লুং ব্রিটিশ প্রতিনিধিকে জানিয়েছিলেন চীনের স্বর্গীয় সাম্রাজ্যে কোনো কিছুরই অভাব নেই, চীনে ব্রিটিশ পণ্যের প্রয়োজন নেই। চীনা সম্রাট ব্রিটিশ সম্রাট তৃতীয় জর্জকে তাঁর করদ নৃপতি বলে উল্লেখ করেছিলেন এবং ব্রিটিশ প্রতিনিধিকে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন যে ব্রিটিশ সম্রাট যেন ভবিষ্যতে চীনা সম্রাটকে আরও বেশি আনুগত্য দেখান। এই মিশনের ব্যর্থতার পরও ব্রিটিশরা হাল ছাড়েনি। ১৮১৬ সালে তারা পুনরায় আমহার্স্টকে চীনে পাঠিয়েছিল। কিন্তু তিনি চীনের 'কাওটাও' প্রথা মানতে রাজি হননি। ফলস্বরূপ এই মিশনও ব্যর্থ হয়েছিল।তাই বলা যায় যে ইংল্যান্ডের চীনা সরকারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যর্থতা ক্যান্টন বাণিজ্যের পতন আসন্ন করেছিল। কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ইংল্যান্ড চীনে যেসব মিশন পাঠিয়েছিল সেগুলো ব্যর্থ হয়েছিল। এই ব্যর্থতার মূল কারণ ছিল চীনা সম্রাটের অদূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি। শিল্পবিপ্লবের পরিণতিতে ইংল্যান্ডের অবস্থার যে আমূল পরিবর্তন হয়েছিল সে সম্পর্কে চীনাদের কোনো ধারণা ছিল না। এজন্যই চীনা কর্তৃপক্ষ সম মর্যাদার ভিত্তিতে ইংল্যান্ডের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে রাজি হয়নি। ইংল্যান্ড যে নিছক চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চেয়েছিল তা নয় বরং ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্য ছিল চীনে ব্রিটিশ বণিকদের অবাধ বিচরণের পথকে পরিষ্কার করা। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা সহজে চীনে কার্যকর হয়নি। তাই পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ইংল্যান্ড শেষ পর্যন্ত চীনে বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য যুদ্ধের পথই বেছে নিয়েছিল। পরিণতিতে চীনের সঙ্গে ইংল্যান্ডের যে যুদ্ধ হয়েছিল তাতে চীন পরাজিত হয়েছিল এবং তার পরিণতিতে ক্যান্টন বাণিজ্যের অবসান হয়েছিল।
0 Comments
If you like the posts, you must comment. and if there is any problem , please let me know in the comments.