নজরানা প্রথা | Tribute System | নজরানা প্রথা বলতে কী বোঝো ? এবং নজরানা প্রথার বিলুপ্তির কারণ |
চীনারা নিজেদের সভ্য জাতি বলে মনে করত। আত্মগর্বে গর্বিত চীনা জাতি বিদেশিদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। তারা বিশ্বাস করত পৃথিবীর মধ্যভাগে অবস্থিত চীন হল সভ্যদেশ এবং অন্য সব দেশ হল বর্বর এবং চীনের করদ রাজ্য। সুসভ্য ও স্বর্গের সন্তান চীন কোনোদিনই সমমর্যাদার ভিত্তিতে বিদেশি করদ রাজ্যগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে না। তাই চীন বিদেশিদের কাছে তার দরজাকে বন্ধ করে রেখেছিল। চীনের বক্তব্য ছিল প্রতিবেশী ও বিদেশি রাজ্যগুলো যেহেতু তার করদ রাজ্য তাই তারা চীনকে সম্মান প্রদর্শনে বাধ্য। চীনের এই ধারণা থেকেই নজরানা বা Tribute System-এর জন্ম হয়েছিল।
চীন দেশের প্রাচীন রীতি অনুসারে চীনা সম্রাট সামস্তপ্রভু ও জমিদারকে জমি দান করতেন। এর বিনিময়ে তিনি তাদের কাছ থেকে উৎপাদিত পণ্য নজরানা হিসাবে পেতেন। কনফুসীয় দর্শন অনুসারে সামন্তপ্রভু ও জমিদাররা নজরানা প্রদান করে চীনা সম্রাটের কাছে আনুগত্য দেখাতে বাধ্য ছিলেন। নজরানা প্রদান চীনাদের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছিল। নজরানা প্রথার মাধ্যমে এটাই প্রতীয়মান হয়েছিল যে, চীনা সম্রাট হলেন পৃথিবীশ্রেষ্ঠ সম্রাট। তিনি স্বর্গপুত্র। তাঁর সমকক্ষ আর কেউ নেই। অন্য সব দেশের শাসক তাঁর অনুগত করদ শাসক।
এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক নির্ধারণেও নজরানা প্রথা কার্যকর ছিল। চীন তার দুর্বল প্রতিবেশী দেশগুলোকে নিয়ে একটি 'জাতি সমূহের পরিবার' অর্থাৎ Family of Nations গড়ে তুলেছিল। এই পরিবারের কর্তা হিসাবে চীন। নিজেকে জাহির করেছিল। এই পরিবারের সদস্য ছিল কোরিয়া, লিউচিউ, আন্নাম, জাপান, শ্যাম, ব্রহ্মদেশ, লাওস ইত্যাদি। এই পরিবারেও কনফুসীয় বিধান কার্যকর ছিল। কনফুসীয় বিধান অনুসারে পরিবারের সব সদস্যদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক থাকবে। পরিবারের কর্তাকে সম্মান দেখাতে হবে। এই রীতি অনুযায়ী প্রতিবেশী দেশগুলো চীনকে মর্যাদা দিতে বাধ্য ছিল। চীনকে মর্যাদার স্বীকৃতি হিসাবে তারা বিভিন্নভাবে ‘নজরানা’ প্রদান করত। মূলত এই পদ্ধতি ছিল আনুগত্য বিষয়ক। চীন যে শ্রেষ্ঠ নজরানার মাধ্যমে এই সত্য স্বীকৃত হয়েছিল। সেজন্য চীনা সম্রাট তার প্রতিবেশী সহ বিদেশি রাষ্ট্রগুলোকে তার সমকক্ষ বলে মনে করতে পারেনি।
চীনারা পাশ্চাত্য সভ্যতাকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করত না। তাদের চোখে পাশ্চাত্য দেশগুলোও ছিল করদ রাজ্য। চীন তাই পাশ্চাত্য দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনেকোনো আগ্রহ দেখায়নি। চীনের বক্তব্য ছিল তাদের সঙ্গে পশ্চিমি দেশগুলো সম্পর্ক স্থাপনে ইচ্ছুক হলে তাদের নজরানা দিতে হবে। চীনের প্রচলিত প্রথা ‘কাওটাও' তাদের পালন করতে হবে। কাওটাও প্রথা হল নতজানু হয়ে মাটিতে মাথা নত করা এবং সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করা। যেকোনো বিদেশি সীমান্ত পেরিয়ে চীনা সাম্রাজ্যে প্রবেশ করলে তাকে তিনবার এই পদ্ধতি পালন করতে হত। চীনা দরবারেও একই প্রথা প্রচলিত ছিল। এই প্রথা পরবর্তীকালে বিদেশিদের সাথে চীনাদের তিক্ত সম্পর্কের মূল কারণ হয়ে উঠেছিল।
একটি বিশেষ দিনে চীন সম্রাট বিদেশিদের কাছ থেকে নজরানা গ্রহণ করতেন। প্রতিবেশী দেশগুলো কী ধরনের নজরানা চীনকে দেবে এবং কখন তা পাঠাবে এবং কোন্ পথ ধরে সেই নজরানা চীনে আসবে তা ঠিক করতেন চীনা সম্রাট। প্রতিবেশী দেশগুলো কতবার নজরানা প্রদান করবে তাও চীন নির্ধারণ করত। সচরাচর দেখা যায় যে দেশের সাথে চীনের সম্পর্ক বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল সেই দেশকে তত বেশি নজরানা পাঠাতে হত। দেখা গেছে কোরিয়া বছরে চার বার, ভিয়েতনাম বা আন্নাম প্রতি দু বছরে একবার, শ্যাম বা থাইল্যান্ড প্রতি তিন বছরে একবার চীনকে নজরানা পাঠাত। নজরানা প্রদানকারী দল চীনা রাজদরবারে উপস্থিত হয়ে ‘কাওটাও’ প্রথাকে মান্য করে নতজানু হয়ে চীনা সম্রাটকে নজরানা প্রদান করতে নজরানা পদ্ধতির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল – যা এই পদ্ধতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রতিবেশী দেশগুলো যখন চীনকে নজরানা পাঠাত সেই দলের সঙ্গে বহু বণিক তাদের পণ্য নিয়ে চীনে আসত। চীন এই বাণিজ্যপণ্যের ওপর কোনো শুল্ক ধার্য করত না। নজরানা প্রদানকারী প্রতিনিধি দলের সমস্ত খরচ চীন বহন করত। প্রতিনিধি দলের সভ্যদের ও বণিকদের Common Residence for Tributary Envoys নামক আবাস স্থলে থাকার ব্যবস্থা চীনা কর্তৃপক্ষ করতেন। প্রতিনিধি দলের বণিকেরা তাদের পণ্যসম্ভার চীনের বাজারে বিক্রি করতেন। এই বাণিজ্য থেকে বিদেশি বণিকেরা যেমন লাভ করতেন তেমনি চীনের নাগরিকরাও বিদেশি পণ্য কিনে নিজেদের চাহিদা পূরণের সুযোগ পেতেন। তাই বলা যায় নজরানা প্রথা চীনের বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি সাধনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিন জরানা প্রদানকারী প্রতিনিধি দলকে চীনা সম্রাট বহুবিধ উপহার প্রদান করতেন। শুধু তাই নয় নজরানা দানকারী দেশগুলোর অলিখিত অভিভাবক হয়ে পড়েছিল চীন। নজরানা প্রদানকারী দেশগুলোর আইনশৃঙ্খলা বজার রাখা, শান্তি অক্ষুণ্ণ রাখা, রাজন্যবর্গের রাজ্যাভিষেকে রাষ্ট্রদূত প্রেরণ করা ও তাদের বৈধ শাসক হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া ইত্যাদি দায়িত্ব চীন পালন করত। এছাড়া ঐ দেশগুলোকে বিদেশি আক্রমণ থেকে রক্ষার নৈতিক দায়িত্ব চীনের ছিল। এমনকি ঐ দেশগুলোতে দুর্ভিক্ষ,ল।ন।মহামারি প্রতিরোধেও চীন তার দায়িত্ব পালন করত। সব ধরনের সাহায্য চীন নজরানা প্রদানকারী দেশগুলোকে দিত। ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো সকল দিক দিয়ে চীনের থেকে শ্রেষ্ঠ হয়েও তারা এই প্রথাকে মানতে বাধ্য হয়েছিল। চীনের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের প্রধান শর্তই ছিল নজরানা প্রথা। পাশ্চাত্য দেশগুলো নিজেদের স্বার্থে এই শর্তকে মেনে ছিল। পোর্তুগাল, হল্যান্ড, রাশিয়া ও ইংল্যান্ড এই প্রথা মানতে বাধ্য হয়েছিল। পশ্চিমি দেশগুলো নজরানা ও কাওটাও প্রথাকে মানতে রাজি না হলে চীন তাদের পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিল চীন তাদের এদেশে আসতে আমন্ত্রণ জানায়নি। তারা নিজেদের স্বার্থে এসেছে। তাই তারা চীনের প্রথা মানতে বাধ্য। পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে ১৬৫৫ সাল থেকে ১৭৯৫ সাল পর্যন্ত পাশ্চাত্য দেশগুলো ১৭ বার চীনে প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিল। মাত্র একবার ছাড়া প্রতিবারই তারা চীনকে শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শনস্বরূপ নজরানা প্রদান করতে বাধ্য হয়েছিল এবং কাওটাও প্রথা মেনে নিয়েছিল। অনিচ্ছা সহকারে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ এই পদ্ধতি মানতে বাধ্য হয়েছিল। বিদেশি শক্তিবর্গের তাই মূল লক্ষ্য ছিল নজরানা প্রথা ও কাওটাও প্রথার বিলোপ সাধন করা।
নজরানা প্রথার বিলুপ্তির কারণ :
পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর কাছে নজরানা প্রথা অসহনীয় হলেও চীনের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর কাছে এই পদ্ধতি খুব একটা অপ্রাসঙ্গিক ছিল না। প্রতিবেশী দেশগুলো নজরানা প্রদানের বিনিময়ে চীনের কাছ থেকে অনেক সুযোগ সুবিধা পেত। চীন ‘বড়োদাদার’ ভূমিকা পালন করত। প্রতিবেশী দুর্বল দেশগুলোকে চীন বহিরাক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করত। দুর্ভিক্ষ, মহামারি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় চীন তাদের সাহায্য করত। চীন নজরানা প্রদানকারী প্রতিবেশী দেশগুলোকে বহু মূল্যবান উপহার দিত। নজরানা বহনকারী প্রতিনিধি দলের যাবতীয় খরচ চীন বহন করত। প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আগত বণিকদের বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার চীন দিয়েছিল। ঐ দেশগুলোর রাজন্যবর্গের রাজ্যাভিষেকের সময় চীনা সম্রাট নিজে উপস্থিত থাকতেন কিংবা তাঁর প্রতিনিধি পাঠাতেন। ফলে ঐ দেশগুলোর জনগণ তাদের রাজাকে বৈধ শাসক হিসাবে মানতে বাধ্য হতেন। জনগণের কাছে চীনা সম্রাট কর্তৃক স্বীকৃত রাজার শাসন মর্যাদা পেত। প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় সব দিক নিয়ে চীন শ্রেষ্ঠ ছিল। চীনের সংস্কৃতির প্রাচীন ঐতিহ্য ছিল। নজরানা প্রথার জন্য ঐ দেশগুলোর সঙ্গে চীনা সংস্কৃতির পরিচয় ঘটত এবং তার প্রভাবে ঐ দেশগুলোতে চীনাদের অনুকরণে সংস্কৃতির পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছিল। সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ রাষ্ট্রের পক্ষে মঙ্গলদায়ক এতে কোনো সন্দেহ নেই।নজরানা প্রথার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও কালক্রমে এই প্রথা তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছিল। পরিণামে এই প্রথার অবলুপ্তি ঘটেছিল। যেসব কারণ নজরানা প্রথার বিলুপ্তির পিছনে দায়ী ছিল সেগুলো হল এরূপ : (১) বিদেশিদের বিরোধিতা ছিল এই প্রথার অবসানের মূল কারণ। পাশ্চাত্য বণিকেরা এই প্রথাকে অপমানজনক ও আপত্তিকর বলে মনে করত। তারা বাণিজ্যের স্বার্থে বাধ্য হয়ে এই প্রথাকে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু তারা সবসময়ই এই প্রথার বিরোধিতা করে এসেছিল। বিশেষ করে ইংল্যান্ডের বণিকেরা প্রথম থেকেই এই নজরানা প্রথাকে মানতে রাজি ছিল না। শিল্পবিপ্লবের দ্বারা সমৃদ্ধ ইংল্যান্ডের কাছে এই প্রথা ছিল রীতিমতো অপমানজনক। তারা চীনা কর্তৃপক্ষের কাছে নজরানা প্রথার অবসানের দাবি করলে চীনাদের বক্তব্য ছিল চীনা জাতি পাশ্চাত্য দেশগুলোকে বাণিজ্যের জন্য আমন্ত্রণ জানায়নি। তা সত্ত্বেও তারা যখন চীনে বাণিজ্য করতে এসেছে তখন তাদের চীনা প্রথা মেনে চলতে হবে। ইংল্যান্ডের বক্তব্য ছিল আন্তর্জাতিক বিধি অনুযায়ী চীনের সাথে তাদের বাণিজ্য চলবে। তারা চীনাদের জানিয়ে দিয়েছিল এই বাণিজ্য তারা বন্ধ করবে না। ফলে বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে চীন ও পাশ্চাত্য দেশগুলোর সম্পর্ক বিশেষকরে ইংল্যান্ডের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হলে নজরানা প্রথার অবসান আসন্ন হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত চীনের সাথে ইংল্যান্ডের আফিং ব্যবসাকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। এই যুদ্ধে চীনের পরাজয়ের পরিণতিতে চীন দীর্ঘদিনের নজরানা প্রথার অবসান ঘটাতে বাধ্য হয়েছিল।
(২) নজরানা প্রথা ছিল যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ। চীনের প্রতিবেশী দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে এই প্রথাকে টিকিয়ে রাখা ছিল খুবই অসুবিধাজনক। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, কোরিয়া যখন চীনে নজরানা পাঠাত তখন তার প্রচুর খরচ হত। কোরিয়ার রাজধানী সিওল থেকে পিকিং-এর দূরত্ব ছিল প্রায় ৭৫০ মাইল। এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে সময় লাগত ৬০ দিনেরও বেশি। এই নজরানা বাহিনীতে কম করে ২০০ ৩০০ জন থাকতেন। তাদের সব খরচ বহন করতে হত কোরিয়ান সরকারকে। নজরানাস্বরূপ যে সামগ্রী তারা চীনা সম্রাটকে দিত তার অর্থমূল্যও ছিল অনেক বেশি। সেজন্য প্রতিবেশী দুর্বল রাষ্ট্রগুলো এই ধরনের প্রথা মেনে চলতে ক্রমশই দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিল। এ ছাড়া প্রতিবেশী করদ রাজ্যগুলোর রাজাদের অভিষেক অনুষ্ঠানে চীনা সম্রাটের প্রতিনিধিরা যোগ দিতেন। তাদের জন্য প্রচুর অর্থ প্রতিবেশী দেশগুলোকে অহেতুক খরচ করতে হত। ফলস্বরূপ ঐ দেশগুলোকে আর্থিক অনটনের মধ্যে পড়তে হত। পরিণতিতে অনেক দেশ তাদের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানকে বেশ কিছু কাল পিছিয়ে দিতে বাধ্য হত। উদাহরণ দিয়ে বলা যায় লিউচিউ তাদের রাজার অভিষেক অনুষ্ঠান প্রায় দু বছর পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। তাই দেখা যায় নজরানা প্রথার বিরোধিতা কেবল পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোই করেনি। চীনেরপ্রতিবেশী করদ রাজ্যগুলোর কাছেও এই প্রথার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছিল। কেবল নজরানা প্রদানকারী প্রতিবেশী দেশগুলোর অনীহা নয় এই প্রথায় চীনেরও তেমন আর্থিক লাভ হচ্ছিল না। নজরানা বহনকারীদের জন্য চীনাদের যে আর্থিক খরচ হত তার তুলনায় চীনারা কম মূল্যের উপহার পেত। ফলস্বরূপ এই প্রথার অবসান আসন্ন হয়ে পড়েছিল।
(৩) চীনের কনফুসীয় সমাজ ব্যবস্থায় বাণিজ্যের গুরুত্ব তেমন ছিল না। কিন্তু অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছিল। এই সময়ে চীনা বণিকেরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যেমন শ্যাম, মালয়, জাভা ইত্যাদি দেশে বাণিজ্য শুরু করেছিল। চীনা বণিকদের এই বাণিজ্যকে 'জাঙ্ক বাণিজ্য' (Junk trade) বলা হত। চীন দেশের বিশেষ ধরনের বাণিজ্য জাহাজকে 'Junk' বলা হত। চীন দেশের বণিকদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে বাণিজ্যের জন্য কোনো নজরানা প্রদান করতে হত না। স্বাভাবিক কারণে চীন দেশের এই বণিকেরা নজরানা প্রথার বিরোধিতা করেছিল। জাঙ্ক বাণিজ্যের প্রসার নজরানা প্রথার বিলুপ্তির অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছি।
(৪) দক্ষিণ চীনের বন্দর শহর ক্যান্টন বিদেশিদের সাথে বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। চীনারা বিদেশিদের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে ইচ্ছুক ছিল না। তবে নানা কারণে চীনা কর্তৃপক্ষ বিদেশিদের ক্যান্টনে বাণিজ্য করার অনুমতি নিয়েছিল। ক্যান্টন বাণিজ্যের মাধ্যমে ইউরোপীয় বণিকেরা চীনের সাথে ব্যাপকভাবে না হলেও সীমিত পরিসরে বাণিজ্য চালিয়েছিল। ক্যান্টন বাণিজ্য ছিল নজরানা প্রথা বহির্ভূত। ক্যান্টন বাণিজ্যে ইংল্যান্ডের ছিল একাধিপত্য। ইংল্যান্ড কোনোদিনই নজরানা প্রথাকে মানতে পারেনি। আফিং বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে চীনের সাথে ইংল্যান্ডের সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার পরিণতিতে প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। এই যুদ্ধে চীন পরাজিত হয়েছিল এবং নজরানা প্রথা রদ করতে বাধ্য হয়েছিল। চীনের সাথে বিদেশিদের সম্পর্ক স্থাপনে নজরানা প্রথার এতদিন যে গুরুত্ব ছিল তা আর থাকেনি। নজরানা প্রথার পরিবর্তে সন্ধি পদ্ধতি গুরুত্ব পেয়েছিল।
এইভাবে দেখা যায় পাশ্চাত্য বণিকদের বিশেষ করে ইংল্যান্ডের বিরোধিতা, জাঙ্ক বাণিজ্যের প্রাধান্য, চীনের প্রতিবেশী করদ রাজ্যগুলোর নজরানা প্রথার প্রতি অনীহা এবং ক্যান্টন বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে ইঙ্গ-চীন সম্পর্কের অবনতি চীন থেকে নজরানা প্রথার বিলুপ্ত ঘটিয়েছিল।
0 Comments
If you like the posts, you must comment. and if there is any problem , please let me know in the comments.