সূচনা:
ইটালির একজন বিখ্যাত রাষ্ট্রচিন্তাবিদ ছিলেন নিকোলো ডি বার্নাডাে ম্যাকিয়াভেলি (১৪৬৯-১৫২৭ খ্রি.)। আধুনিক রাষ্ট্রতত্ত্বের ভিত নির্মাণের কারণে তাকে ‘আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক’, ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নিউটন’ প্রভৃতি আখ্যা দেওয়া হয়।
রচিত রাষ্ট্রগ্রন্থসমূহ:
ম্যাকিয়াভেলি রচিত কয়েকটি গ্রন্থ হল— ‘দ্য প্রিন্স’, ‘দ্য ডিসকোর্সেস অন দ্য ফাস্ট ডিকেড অব লিভি’, ‘মান্ট্রোগােলা’, ‘আট অব ওয়ার প্রভৃতি। তবে তার সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাবনার প্রতিফলন মেলে ‘দ্য প্রিন্স’ গ্রন্থে। এই গ্রন্থে ম্যাকিয়াভেলি রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিচালনার বিধিনিষেধগুলি আলােচনা করেছেন।
রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য:
ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রতত্ত্ব থেকে রাষ্ট্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন- ① ধর্মনিরপেক্ষতা: তিনি চার্চ ও ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্কহীন সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছেন। ② মানুষের গুরুত্ব: মানুষ নিজের স্বার্থসিদ্ধি ও নিরাপত্তার প্রয়োজনেই রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে স্বাগত জানায়। ③ ক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা: প্রতিটি রাষ্ট্র সর্বদা নিজ ক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা চালায়। ④ সরকারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি: মানুষের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা দিয়ে নিজের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির দিকে নজর দেওয়াই হবে রাষ্ট্রের সরকারের লক্ষ্য। ⑤ প্রশাসনে জনগণের অংশগ্রহণ: যে রাষ্ট্রের প্রশাসনে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে তা ম্যাকিয়াভেলির বিচারে শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র।
∆ ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তার প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়সমূহ:
(১) মানবপ্রকৃতি: ম্যাকিয়াভেলি তাঁর চিন্তাধারার কেন্দ্রবিন্দুতে মানুষকে স্থান দিয়েছেন। তিনি রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের ভিত্তিতে মানবচরিত্রকে বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর মতে, মানুষ অকৃতজ্ঞ, প্রতারক, কাপুরুষ ন্যায়নীতিবোধহীন ও অর্থলিপ্স। এর ফলে মানুষের মধ্যে ক্ষমতা ও অর্থলাভের চাহিদা বাড়তে থাকে। এইজন্য মানুষে মানুষে সংঘাত সৃষ্টি হয় এবং রাষ্ট্রের মধ্যে বিশৃঙ্খলা লক্ষ করা যায়।
(২) রাষ্ট্রের শ্রেণিবিভাগ:
ম্যাকিয়াভেলি অ্যারিস্টটলের অনুকরণে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সরকারকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন, যথা- রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্র বা প্রজাতন্ত্র। তিনি মনে করতেন যে, একমাত্র সবল রাজতন্ত্রই রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করতে এবং জাতির
গৌরব ও মর্যাদা বৃদ্ধি করতে পারে।
(৩) রাজতান্ত্রর স্বরূপ নির্ণয়:
ম্যাকিয়াভেলি তাঁর The Prince গ্রন্থে রাজতন্ত্র সম্পর্কে আলোচনায় বলেছেন, রাজার প্রধান দায়িত্ব রাজ্যকে সুরক্ষিত করা। এ ছাড়াও রাজার কাজ হবে যে-কোনোভাবে রাজ্যশাসনের ভিত্তি সুদৃঢ় করা। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য রাজাকে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হতে হবে। রাজাকে তাঁর কাজকর্মে সাহস, দৃঢ়তা ও বীরত্ব দেখাতে হবে। পাশাপাশি যে-কোনো পরিস্থিতিতে রাজা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন এবং বিরোধীপক্ষকে বলপ্রয়োগের দ্বারা দমন করবেন। এককথায় রাষ্ট্রের গৌরব ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য রাজতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তার কথা ম্যাকিয়াভেলি উল্লেখ করেন।
(৪) প্রজাতন্ত্রের স্বরূপ:
ম্যাকিয়াভেলি প্রজাতান্ত্রিক শাসনকে মুক্ত রাষ্ট্র (Free States) বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেছেন যে, রোমান প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতা বিরাজমান ছিল। কিন্তু জুলিয়াস সিজার ও অন্যান্য সম্রাটগণ প্রজাতন্ত্রকে ধ্বংস করে সকল রাজনৈতিক ক্ষমতা নিজেদের হাতে কেন্দ্রীভূত করলে সেখানে স্বাধীনতা ধ্বংস হয়। তিনি প্রজাতন্ত্রকে অন্য সব ধরনের শাসনের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর বলে স্বীকার করেছেন। ম্যাকিয়াভেলির মতে, "জনগণের কণ্ঠই হল ঈশ্বরের কণ্ঠ।"
(৫) মূল্যায়ন:
ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তা পরস্পরবিরোধী অভিমত হিসেবে যথেষ্ট সমালোচিত হয়েছে। এ ছাড়াও তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্বের ত্রুটি হিসেবে মানুষের সদ্গুণাবলি উপেক্ষা, খণ্ডিত জাতীয়তাবোধ, বলপ্রয়োগকে গুরুত্ব দান, অসমাপ্ত তথ্য, যুগবিরোধী চিন্তা, ত্রুটিপূর্ণ ক্রমবিন্যাস প্রভৃতি বিষয়ের কথা বলা হয়ে থাকে। তবে ত্রুটিবিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও, ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তা ব্যক্তির নৈতিকতা ও রাষ্ট্রের নৈতিকতার পার্থক্যকরণ, ক্ষমতা সংক্রান্ত তত্ত্ব, বুর্জোয়া শ্রেণির গুরুত্ব উপলব্ধি, অভিজ্ঞতার উপর গুরুত্ব আরোপ প্রভৃতি দিক থেকে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।
সর্বোপরি বলা যায়, ম্যাকিয়াভেলির চিন্তাধারায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান আধুনিক রূপলাভ করেছিল। তাই আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পথিকৃৎ হিসেবে ম্যাকিয়াভেলির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
Q) আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ হিসেবে অ্যারিস্টটলের ভূমিকা লেখ ?
0 Comments
If you like the posts, you must comment. and if there is any problem , please let me know in the comments.