তাইপিং ও বক্সার অভ্যুত্থানের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করো।
উনিশ শতকে চীনে বহু বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু তার মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় বিদ্রোহ হল ১৮৫০ সালের তাইপিং বিদ্রোহ এবং ১৯০০ সালের বক্সার অভ্যুত্থান। এই দুই কালজয়ী ঘটনা চীনের ইতিহাসের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। সময় এবং উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে এই দুই বিদ্রোহের মধ্যে বেশ ফারাক ছিল। কিন্তু এই দুইঅভ্যুত্থানই ছিল প্রতিষ্ঠান বিরোধী সংগ্রাম। দুটো ক্ষেত্রেই চীনের সাধারণ মানুষ যোগ দিয়ে এই সংগ্রামকে প্রাণবস্তু করেছিল। প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম কেন্দ্র চীন নিজের সভ্যতাকে পাশ্চাত্যের সভ্যতারথেকেও শ্রেষ্ঠ মনে করে বহুদিন পর্যন্ত বিদেশি শক্তিবর্গের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক স্থাপন করেনি। কিন্তু বিদেশি শক্তিবর্গ বিশেষ করে ইংল্যান্ড বিশাল চীনের সাথে বাণিজ্য করার প্রয়াসে প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চীনারা তাদের নীতি থেকে সরে না এলে ব্রিটিশরা সনাতন পদ্ধতি অর্থাৎ যুদ্ধ নীতির আশ্রয় নিয়েছিল। আফিংকে কেন্দ্র করে চীনের সাথে ইংল্যান্ডের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। যুদ্ধে চীন শোচনীয় রূপে পরাজিত হয়েছিল এবং অপমানকর নানকিং চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। ইংল্যান্ডের হাতে শোচনীয় পরাজয়ের পর চীনের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। ইংল্যান্ড ছাড়াও অন্যান্য বিদেশিরাও চীনের বিপন্নতার সুযোগ নিয়েছিল। তারা চীনের সাথে যে সব চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল সেগুলি ছিল অসম চুক্তি। বিদেশি শক্তিবর্গ চীনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে চীনের কাছ থেকে অতিরাষ্ট্রীয় অধিকার, সর্বাধিক সুবিধাপ্রাপ্ত জাতির মর্যাদা ও শুষ্ক ক্ষেত্রে ছাড় পেয়েছিল। চীনের অভ্যন্তরে বিদেশিরা উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। এখানে বিদেশিরা বসবাসের সুযোগ পেয়েছিল এবং নিজস্ব ধর্ম পালনের জন্য ধর্ম প্রতিষ্ঠান স্থাপনের সুযোগ পেয়েছিল। পরিণতিতে চীন একটি আধা-সামন্ততান্ত্রিক ও আধা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে পড়েছিল। উন্নত জীবনের লোভে বহু চীনা স্বধর্ম ছেড়ে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিল। বিদেশিদের প্রভাবে চীনের ঐতিহ্যগত সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও আর্থিক বনিয়াদ নষ্ট হয়ে পড়েছিল। দুর্বল শাসকবর্গ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারেনি। তারা সামন্ততান্ত্রিক শোষণ থেকে কৃষক ও দরিদ্র মানুষকে রক্ষা করতে পারেনি। মাঞ্চু শাসনের বিরুদ্ধে জনগণ সোচ্চার হয়েছিল। চীনের অভ্যন্তরে বিদ্রোহের বীজ রোপিত হয়েছিল। সাধারণ চীনারা মাঞ্চুদের বিদেশি বলেই মনে করত। মনে রাখা দরকার মাঞ্চুরা ছিলেন বিদেশি তাতার বংশের লোক। চীনাদের সঙ্গে তাদের জাতিগত পার্থক্য ছিল। যতদিন মাঞ্চুরা শক্তিশালী ছিলেন ততদিন এইসব বিষয় বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু বিদেশি শক্তিবর্গের কাছে যখন চীন বার বার পরাজিত হয়েছিল তখন মাঞ্চু রাজাদের প্রতি সব আনুগত্যের বন্ধন শিথিল হয়ে পড়েছিল। এছাড়া অর্থনৈতিক দিক দিয়ে চীন তখন দেউলে হয়ে গিয়েছিল। ক্ষতিপূরণের অর্থ মেটাতে গিয়ে চীনের অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে পড়লে মাঞ্চু শাসকেরা জনগণের ওপর বর্ধিত কর আরোপ করলে করভারে জর্জরিত সাধারণ মানুষ বিদ্রোহে শামিল হয়েছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত সমস্যা শাসকদের বিপদে ফেলেছিল। জনসংখ্যা বাড়লেও সেই হারে কৃষি যোগ্য জমি বাড়েনি। খাদ্যসংকটে চীনের জনগণ জর্জরিত হয়ে পড়েছিল। বাণিজ্যের ঘাটতি আর্থিক সংকটকে আরও জোরালো করলে চীনের রাজশক্তি দুর্বলহয়ে পড়েছিল। প্রাদেশিক শাসকেরা শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। এই পরিস্থিতিতে তাইপিং বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল।
বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি ধীরে ধীরে চীনের ওপর আধিপত্য কায়েম করেছিল। বিদেশি শক্তির কাছে চীন ছিল মৃগয়াভূমি। বিদেশি শক্তিবর্গ চীনের বিভিন্ন অঞ্চল অধিকার করে নিজেদের প্রভাব বাড়িয়েছিল। চীনের কাছ থেকে বিদেশিরা অতিরাষ্ট্রীয় অধিকার, বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত জাতির মর্যাদা লাভ, বাণিজ্য সংক্রান্ত সুযোগ সুবিধা ইত্যাদি লাভ করে চীনের সার্বভৌমত্বকে লাঞ্ছিত করে দিয়েছিল। চীনের সাধারণ মানুষ বিদেশিদের দ্বারা চীনের এই লাঞ্ছনা সহ্য করতে পারেনি। তারা সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছিল যে এইভাবে বিদেশিদের দাপট চলতে থাকলে চীন পরাধীন হয়ে পড়বে। প্রিন্স কুং ১৮৯৮ সালে ন্যাশনাল প্রোটেকশন সমিতির সভায় উল্লেখ করেছিলেন ব্রহ্মদেশ, আন্নাম, ভারত বা পোল্যান্ডের মতো চীনও পরাধীন হয়ে পড়বে। চীনের সর্বত্র বিদেশিদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠেছিল। দেশের সাধারণ মানুষের এই ধারণা হয়েছিল যে চীনের দারিদ্র্যতা, বিপর্যয় সকল ক্ষেত্রের জন্য বিদেশিরা দায়ী। বিদেশিদের সব কাজ চীনারা পছন্দ করেনি। বিদেশিরা যেসব কাজ করেছিলেন যেমন রেলপথ স্থাপন, ডাক ও তার ব্যবস্থার প্রচলন, চার্চ প্রতিষ্ঠা এবং সেবামূলক সব কাজকেই তার সন্দেহের চোখে দেখেছিল। এছাড়া খ্রিস্টান মিশনারিরা ভয় দেখিয়ে সাধারণ চীনাদের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করত। বিদেশিদের আচরণ ও খ্রিস্টান মিশনারিদের ধর্মীয় কার্যকলাপ চীনাদের জাতীয়তাবাদী দত্তেও আত্মমর্যাদায় আঘাত হেনেছিল । চীনে বরাবরই গুপ্ত সমিতি গঠনের প্রবণতা ছিল। আর্থিক সংকটে জর্জরিত চীনারা এইসব সমিতিতে যোগ দিয়েছিল। এইসব সমিতির মধ্যে অন্যতম ছিল 'আই-হো-চুয়ান'। এই সমিতির সভ্যরা নানা ধরনের মন্ত্রতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। তাদের ধারণা ছিল এই মন্ত্রবলে তারা বিদেশিদের গোলাগুলিকে প্রতিরোধ করতে পারবে। তাদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল খ্রিস্টান। মিশনারিরা। চীনের সাধারণ মানুষ বিদেশিদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণায় প্রতিবাদ করেছিল। এবং তাদের নেতৃত্বেই জন্ম নিয়েছিল বক্সার আন্দোল।
এই দুই আন্দোলন চীনের আধুনিক ইতিহাসের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। এই দুই আন্দোলনের মধ্যে মিল এবং অমিল দুইই ছিল। তাইপিং বিদ্রোহ ছিল মাঞ্চু শাসন বিরোধী আন্দোলন। চীনকে মাঞ্চুদের অপশাসনের হাত থেকে মুক্ত করাই ছিল এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। দক্ষিণ চীনে মাঞ্চু শাসন কোনোদিনই জনপ্রিয় ছিল না। তারা মাঞ্চুদের বিদেশি বলেই মনে করত। এই শাসকদের অকর্মণ্যতার জন্যই চীন বিদেশিদের দ্বারা পদানত হয়েছে। চীনকে প্রচুর অর্থ ক্ষতিপূরণস্বরূপ বিদেশিদের দিতে হয়েছে বলে চীনের আর্থিক বনিয়াদ ভেঙে পড়েছিল। এই প্রসঙ্গে মার্কসের বক্তব্য হল যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ ইংল্যান্ডকে প্রচুর অর্থ প্রদান, প্রচুরন।পরিমাণে আফিং আমদানির ফলে অর্থের অপচয়, বিদেশি শিল্পজাত পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতায় দেশের কুটির শিল্প নষ্ট হয়েছিল বলে চীনের আর্থিক বনিয়াদ ভেঙে পড়েছিল। শাসনের ক্ষেত্রে এর দুটো কুফল লক্ষ করা গিয়েছিল। পুরোনো কর ব্যবস্থা আরও কঠোর হয়েছিল এবং নতুন কর চাপানো হয়েছিল। এই কর বৃদ্ধিজনিত সমস্যা মাঞ্চু শাসনকে বিপদে ফেলেছিল। তাইপিং বিদ্রোহীরা এই অপশাসন দূর করে চীনে ‘তাইপিং তিয়েন কুও' বা মহতী শান্তির রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।
অন্যদিকে বক্সার অভ্যুত্থান ছিল বিদেশি বিরোধী আন্দোলন। অবশ্য প্রথমদিকে এই আন্দোলনও মাঞ্চু বিরোধী ছিল। তারা বিদেশিদের আক্রমণ করে, পশ্চিমি শক্তির সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি করে মানুদের উৎখাত করতে চেয়েছিল। আন্দোলনকারীদের তখন স্লোগান ছিল 'চিং রাজবংশকে উৎখাত কর এবং বিদেশিদের খতম কর। কিন্তু কিছুদিন পরই রাজদরবার বিশেষ করে রাজমাতা যুশি আন্দোলনকারীদের পক্ষে এসেছিলেন এবং তিনি বিদেশি বিরোধী আন্দোলনে গোপনে তাদের মদত দিয়েছিলেন। ফলে আন্দোলনকারীরা মাঞ্চু শাসনের সমর্থকে পরিণত হয়েছিল। এই সময়ে তাদের স্লোগান ছিল 'চিং বংশকে সমর্থন কর এবং বিদেশিদের ধ্বংস কর। এই সময় থেকে আন্দোলন বিদেশিদের বিরুদ্ধে তীব্র আকার ধারণ করেছিল। জ্যাক প্রের মতে বক্সারদের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিদেশিদের চীন থেকে বিতাড়িত করা। ফেয়ারব্যাঙ্কের মতে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদীদের উপস্থিতির ফলে চীনের অনজীবনে যে গভীর সংকট সৃষ্টি হয়েছিল বক্সার বিদ্রোহ ছিল তার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম।
তাইপিং ও বক্সার আন্দোলনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য যে এক এবং অভিন্ন ছিল তা বলা যায় না। তাইপিং বিদ্রোহীরা বিদেশিদের বিরোধিতা করেনি বরং তারা বিদেশিদের সাহায্য নিয়েছিল। অন্যদিকে বক্সাররা বিদেশি খ্রিস্টান মিশনারিদের চীন থেকে বিতাড়িত করে চীনকে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদ মুক্ত করতে চেয়েছিল। তারা মিশনারিদের সাম্রাজ্যবাদের দালাল হিসাবে গণ্য করেছিল। তাইপিং বিদ্রোহের পিছনে খ্রিস্টধর্মের এক প্রভাব ছিল। তাদের কাছে খ্রিস্টধর্ম এক নতুন বার্তা এনেছিল। এই বিদ্রোহের নায়ক হুং-শিউ-চুয়ান খ্রিস্টধর্মের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তিনি এই ধর্ম নিয়ে পড়াশুনাও করেছিলেন। ফলে খ্রিস্টধর্মের প্রতি তাঁর মনে শ্রদ্ধাভাব জেগে উঠেছিল। তিনি প্রচার করেছিলেন যিশুখ্রিস্ট তাকে ছোটো ভাই বলে ডেকেছেন এবং সমস্ত অনাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন। সামন্ততান্ত্রিক কনফুসীয় পন্থার প্রতিবাদ হিসাবে তাইপিং বিদ্রোহীরা খ্রিস্টধর্মকে বরণ করেছিলেন।
পক্ষান্তরে বক্সার আন্দোলনকারীরা খ্রিস্টধর্মের প্রতি ছিলেন খড়গহস্ত। খ্রিস্টান মিশনারিদের জন্য চীনের প্রচলিত ধর্ম যেমন কুনফুসীয়, তাও ও বৌদ্ধধর্ম বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। গরিব চীনাদের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে তারা জোর করে খ্রিস্টধর্মেদীক্ষিত করেছিল। ১৮৬০ সালের পর অর্থাৎ পিকিং কনভেনশনের পর খ্রিস্টান মিশনারিরা চীনে জমি কেনার অধিকার পেয়েছিল। তারা চার্চ প্রতিষ্ঠা করেছিল। রণতরী এবং অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তারা চীনের অভ্যন্তরে ঘুরে বেড়াত এবং সুযোগ পাওয়ামাত্র চীনাদের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করত। ধর্মান্তরিত চীনা খ্রিস্টানরা চীনের দেবতাদের মানত না, কনফুসীয় নীতিকে মান্য করত না, পূর্বপুরুষদের সমাধিতে নতজানু হত না, চীনের উৎসবগুলোতে অংশ নিত না। তারা চীনাদের অবজ্ঞা করত। প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসের উপর খ্রিস্টানদের এই ধরনের মনোভাবের জন্য চীনে বিদেশিদের বিরুদ্ধে জনরোষ প্রবল হয়েছিল। চীনের সমাজ ও সংস্কৃতির পক্ষে এই ধর্ম বিপজ্জনক বলে প্রচার হয়েছিল। বলা হয়েছিল চীন থেকে বিদেশিদের বিতাড়িত করা হলে দেশে আবার বৃষ্টি আসবে, নদীতে বন্যা হবে। অর্থাৎ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে চীন রক্ষা পাবে। বক্সার আন্দোলনের সময় খ্রিস্টধর্ম হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদীদের বিতাড়নের মূল বিষয়। পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদের শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বক্সার আন্দোলনকারীরা সোচ্চার হয়েছিল।
মতাদর্শগত দিক দিয়েও এই দুই আন্দোলনের মধ্যে বেশ কিছু তারতম্য ছিল। তাইপিং বিদ্রোহের মধ্যে এমন কিছু আদর্শগত দিক ছিল সেগুলি ছিল একেবারে আধুনিক। তাইপিং বিদ্রোহীরা ন্যায় ও সাম্যের ওপর ভিত্তি করে এক নতুন সমাজ গঠন করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা এক নতুন ধরনের ভূমি ব্যবস্থার প্রচলন করতে চেয়েছিলেন। জমির মালিকানা রাষ্ট্রের হাতে রেখে প্রয়োজন অনুযায়ী কৃষকদের তাঁরা জমি দেওয়ার কথা বলেছিলেন। ‘কৃষক কল্পরাজ্য'কে তাঁরা বাস্তবায়িত করতে চেয়েছিলেন এবং মাঞ্চু বিরোধী জাতীয়তাবাদকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। কৃষক, নিম্নবর্গের খেটে খাওয়া ও জীবনযুদ্ধে পরাজিত মানুষ এই বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল। এই বিদ্রোহ গণবিদ্রোহের রূপ নিয়েছিল। আন্দোলনকারীরা এক স্বর্গরাজ্যের ছবি সাধারণ মানুষের কাছে এঁকে দিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষদের সামনে তাঁরা যে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তাকে তাঁরা বাস্তবায়িত করেছিলেন। সমাজে যে সব খারাপ প্রবণতা ছিল সেগুলিকে দূর করে তাঁরা এক উন্নত জীবনের বনিয়াদ রচনা করেছিলেন। বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী, বিধবা, অনাথ ও শিশুদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সামাজিক সংস্কারের ক্ষেত্রেও তাঁরা সফল হয়েছিলেন। পুরুষদের বহু বিবাহ, গণিকাবৃত্তি ও মেয়েদের পদবন্ধন প্রথাকে তাঁরা রদ করেছিলেন। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সম্পত্তিকে বাজেয়াপ্ত করে তাঁরা সাম্যবাদের দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন। তাঁরা চীনে এক বিকল্প রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করে মাঞ্চু শাসনকে বিপদে ফেলেছিলেন। তাইপিং বিদ্রোহ ছিল প্রগতিশীল ও প্রথাগত সমাজব্যবস্থার বিরোধী কিন্তু আদর্শগত দিক দিয়ে বিচার করলে বক্সার বিদ্রোহকে কোনো সময়ই প্রগতিশীল বা আধুনিক বলা যাবে না। বক্সার আন্দোলনকারীদের মধ্যে প্রাক-আধুনিক।সনাতন ধ্যানধারণার প্রভাব বেশি মাত্রায় ছিল। তাঁরা অন্ধ ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর বেশি জোর দিয়েছিলেন। তাঁরা মন্ত্রতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁরা প্রচার করেছিলেন বিদেশিদের গোলাবারুদকে মন্ত্র দিয়ে প্রতিহত করা যাবে। তাঁরা জনগণকে কোনো মতাদর্শের দ্বারা প্রভাবিত করতে পারেননি। পশ্চিমি ঐতিহাসিকেরা এই আন্দোলনকে ‘গ্রীষ্মকালীন পাগলামি' বলে উল্লেখ করেছেন।
স্থায়িত্বের দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যায় যে তাইপিং বিদ্রোহ অনেক দিন স্থায়ী হয়েছিল। ব্যাপকতার দিক দিয়েও এই বিদ্রোহ চীনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছিল। তাইপিং বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল কোয়াংসি প্রদেশের তিয়েন সেন গ্রামে। তারপর এই বিদ্রোহ চীনের এক ব্যাপক অঞ্চলে বিস্তৃত হয়েছিল। দক্ষিণ চীনে তারা এক বিকল্প রাষ্ট্রব্যবস্থা স্থাপন করেছিল। বিদ্রোহীরা কৃষক সহ সকল শ্রেণীর মানুষের সমর্থন পেয়েছিলেন। তাঁরা প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরোধী ছিলেন। দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে বিদ্রোহীরা চীনে এক সমান্তরাল রাষ্ট্রব্যবস্থাকে কার্যকর করেছিলেন।
অন্যদিকে বক্সার বিদ্রোহ এত ব্যাপক ছিল না। এই বিদ্রোহ মাত্র ২ বছর ধরে চলেছিল। এই বিদ্রোহ ছিল শহরকেন্দ্রিক এবং খ্রিস্টান মিশনারি অধ্যুষিত অঞ্চলেই ছিল এর কার্যক্ষেত্র। এদের কার্যপদ্ধতি ছিল অবাস্তব। তাদের চিন্তাধারায় আধুনিকতার কোনো স্পর্শ ছিল না। তারা পুরোনো পন্থায় বিশ্বাসী ছিল।
এই দুই বিদ্রোহের মধ্যে সাংগঠনিক কর্মসূচির মধ্যেও অনেক পার্থক্য ছিল। তাইপিং বিদ্রোহীরা বক্সার আন্দোলনকারীদের তুলনায় অনেক এগিয়েছিলেন। তাঁরা এক বিকল্প রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থার রূপায়ণ করতে চেয়েছিলেন। এই ব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য তাঁরা দক্ষ সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। তাইপিং নেতা হুং-শিউ চুয়ান ‘তাইপিং-তিয়েন-কুও' নামক এক স্বর্গীয় রাজ্য স্থাপনের কথা বলেছিলেন। তাঁরা মাঞ্চুদের অপশাসনের হাত থেকে চীনা জনগণকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। মাঞ্চু শাসনের অবসান ঘটিয়ে তাঁরা চীনে এক মহান স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা চীনের ঐতিহ্য অনুসরণ করে নানকিং-এ রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। তাঁদের শাসনে জাতীয়তাবাদ কার্যকর ছিল বলে জমিদার, পণ্ডিত সকলেই এতে শামিল হয়েছিলেন। বিদ্রোহীরা শান্তির স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চীনে আধুনিকতার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। জমির সমবণ্টন, নারীজাতির কল্যাণসাধন আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন, ডাক ও রেলপথের প্রবর্তন, ধর্মীয় স্থানগুলোকে হাসপাতালে রূপান্তরিত করা এইসব কাজ অবশ্যই ইতিবাচক ছিল। পরবর্তীকালে সাম্যবাদীরাও এদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
বক্সার বিদ্রোহীদের মধ্যে এ ধরনের কোনো উন্নয়নমূলক কর্মসূচি ছিল না। বিদ্রোহীদের কোনো সাংগঠনিক দক্ষতাও ছিল না। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল নেতিবাচক।বিদেশিদের হত্যা ও বিতাড়ন ছাড়া অন্য কোনো কর্মসূচি তাদের ছিল না। চীনকে প্রগতিবাদী রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলার কোনো উদ্যোগ তাদের ছিল না। বিদ্রোহকে সফল করার জন্য কোনো সংগঠন তারা তৈরি করতে পারেনি। নেতৃত্বের দক্ষতাও তাদের ছিল না। নানা ধরনের মানুষ বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল জেন্ট্রি শ্রেণীও এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। পশ্চিমি ভাবধারাকে প্রতিরোধ করাই ছিল আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য। এই ধরনের নেতিবাচক আন্দোলন সংগত কারণেই ব্যর্থ হয়েছিল। অন্ধ বিদেশি বিরোধিতার জন্যই এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল।
সবক্ষেত্রেই দুই আন্দোলনের মধ্যে বৈসাদৃশ্য ছিল না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুই আন্দোলনের মধ্যে সাদৃশ্য ছিল। দুই বিদ্রোহের পিছনে ছিল গুপ্ত সমিতির ভূমিকা। চীনে গুপ্ত সমিতি গঠনের প্রবণতা ছিল বেশি। এই সমিতিগুলি প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির বিরুদ্ধে বরাবরই সোচ্চার ছিল। যেমন শ্বেতপদ্ম সমিতির নেতৃত্বে ১৭৯৬ থেকে ১৮০৪ সাল পর্যন্ত আন্দোলন চলেছিল। তাইপিং বিদ্রোহের পিছনেও গুপ্ত সমিতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ‘ঈশ্বর উপাসনা সমিতি' তাইপিং বিদ্রোহের সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বক্সার বিদ্রোহে গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিয়েছিল আই-হো চুয়ান নামক গুপ্ত সমিতি। এছাড়াও এই দুই বিদ্রোহে সমাজে নীচু শ্রেণীর মানুষরা অংশ নিয়েছিলেন। বিশেষ করে দুই বিদ্রোহেই কৃষকদের ভূমিকা ছিল উজ্জ্বল। এই দুই বিদ্রোহ থেকে পরবর্তীকালের আন্দোলনকারীরা এই শিক্ষা নিয়েছিলেন যে বিদেশিদের থেকেও চীনের পক্ষে বেশি ক্ষতিকারক হল মাঞ্চু শাসকেরা। এই উপলব্ধিই ১৯১১ সালের বিদ্রোহে মাঞ্চুদের পতন নিশ্চিত করে দিয়েছিল।
0 Comments
If you like the posts, you must comment. and if there is any problem , please let me know in the comments.