ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে খ্রিস্টান মিশনারীদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করো। | ভারতের পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাসে খ্রিস্টান মিশনারীদের ভূমিকা |
সরকারি উদ্যোগের বাইরে ভারতে শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন খ্রিস্টান মিশনারীরা। কোম্পানীর কর্মকর্তারা এদেশে খ্রিস্টান মিশনারীদের কাজকর্মের বিরোধী ছিলেন। কারণ মিশনারীদের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য ছিল এদেশে খ্রিস্টধর্মের বাণী প্রচার করা এবং ধর্মান্তরিত করার অনুকূল পরিস্থিতি গড়ে তোলা। এই লক্ষ্যপূরণের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে তাঁরা এদেশে শিক্ষাবিস্তার কর্মসূচী নেন। কিন্তু সরকার মনে করত যে, মিশনারীদের কাজ ভারতবাসীর ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করবে এবং বিরূপ সামাজিক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেবে। কোম্পানীর বিরোধিতা সত্ত্বেও মিশনারীরা শিক্ষা প্রসারের কাজ চালিয়ে যান। সম্ভবত এই কারণে প্রখ্যাত ব্যাপটিষ্ট মিশনারী ইউলিয়াম কেরী নিজের উদ্দেশ্য গোপন করে ভারতে প্রবেশ করেন ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে।
প্রাচ্যবাদী ভাবধারা গড়ে তোলার জন্য এশিয়াটিক সোসাইটি এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রতিষ্ঠা ছাড়াও ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে ব্যাপটিস্ট মিশন প্রতিষ্ঠত হয়েছিল। ভারতবর্ষে খ্রিস্টান মিশনারীদের লক্ষ্য ছিল ভারতে খ্রিস্টানধর্ম প্রচার করে অধিক সংখ্যক ভারতীয়কে খ্রিস্টানধর্মে ধর্মান্তরিত করা। মিশনারীরা উপলব্ধি করেছিলেন যে, এই লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রাথমিক পদক্ষেপ ছিল ভারতে শিক্ষাবিস্তার। মার্কুইস অফ হেস্টিংসের গভর্নর জেনারেল হিসাবে আমার আগে পর্যন্ত কোম্পানি সরকার মিশনারী কার্যকলাপের বিরোধী ছিল। কারণ ইংরেজ শাসকদের মনে ভয় ছিল যে তাদের কার্যকলাপ এদেশের ধর্মীয় ভারসাম্য কষ্ট করবে এবং তা সামাজিক অসন্তোষের জন্ম দেবে। কিন্তু খ্রিস্টান মিশনারীরা শাসকদের সুনজরে আসবার জন্য তাদের সবরকম ভাবে তোষণ করত এবং এশিয়াটিক সোসাইটি ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রাচ্যবাদী কর্মসূচীতে অংশ নিতে শুরু করছিল। শ্রীরামপুরের ব্যাপটিষ্ট মিশনারীরা নিজেদের মুদ্রণ যন্ত্র বসিয়েছিল এবং বাংলা ভাষায় বিভিন্ন লেখা ছাপাতে আরম্ভ করেছিল। লর্ড ওয়েলেসলি প্রাচ্যবাদী ভাবধারা প্রচারের জন্য শ্রীরামপুর মিশনারিদের সহযোগিতা গ্রহণ করেছিলেন। ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ব্যাপটিস্ট মিশনারীরা এশিয়াটিক সোসাইটি ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকে নানাভাবে সহযোগিতা করতে শুরু করে।
মার্শম্যান ও উইলিয়াম ওয়ার্ডের পরামর্শে ডাচ উপনিবেশ ধীরামপুরে 'ব্যাপটিস্ট মিশন' প্রতিষ্ঠা করে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে। এঁদের উদ্যোগে ধীরামপুরের চতুর্দিকে বহু প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। শিক্ষানুরাগী খ্রিস্টান মিশনারীদের 'বলা হত 'ইভানজেলিষ্ট'। চার্লস গ্রান্ট প্রমুখের নেতৃত্বে ভারতে ইংরেজী শিক্ষার প্রসার এবং খ্রিস্টান মিশনারীদের অবাধ কার্যপরিচালনার সপক্ষে প্রচার শুরু করেন। তাঁরা যুক্তি তথ্য দিয়ে প্রমাণ করেন যে, ভারতে কুসংস্কার ও পশ্চাদপদতার অবসানের জন্য ইংরাজী শিক্ষা ও খ্রীষ্টাধর্ম প্রচার করা প্রয়োজন। এঁদের দীর্ঘ চেষ্টার ফলে সরকার শেষ পর্যন্ত মিশনারীদের ধর্মপ্রচারের দাবি মেনে নেয়। ইভানজেলিষ্টদের বক্তবে হিন্দুধর্ম, ভারতীয় সংস্কৃতি এমনকি এদেশে প্রচলিত সমস্ত কিছুকেই নগ্নভাবে আক্রমণ করা হয়। ভারতীয় ঐতিহ্যের সম্পূর্ণটাই বর্জনীয়, এদের এই অভিমত অবশ্যই গ্রহণযোগ্য নয়, তবে এদের উদ্যোগে ভারতে শিক্ষাপ্রসারের ক্ষেত্রে যে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছিল, তা অনস্বীকার্য। কেরী রামায়নের ইংরাজী অনুবাদ করেন ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁরই উদ্যোগে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট' অনূদিত হয়। বাংলা ব্যাকরণের নতুন সংস্করণ প্রকাশ করা হয়। এতে তিনি বাংলাভাষার ভিত্তি হিসাবে সংস্কৃত ভাষার গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। কেরী ইংরাজী শিক্ষর পাশি মাতৃভাষা শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন এবং বাংলা ভাষায় পাশ্চাত্য বিজ্ঞান শিক্ষা প্রসারের দিকে দৃষ্টি দিতে বলেন। ব্যাপটিস্ট মিশনের উদ্যোগে শ্রীরামপুরে একটি ইংরাজী বিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে। এটিই বর্তমানে 'শ্রীরামপুর কলেজ।
কলিকাতার প্রথম বিশপ মিডলটন শিবপুরে বিলস কলেজ স্থাপন করে ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে। ডাফ উচ্চবর্গীয় ভারতীয়দের মধ্যে খ্রীষ্টধর্মের মর্মবাণী ও পাশ্চাত্য যুক্তিবাদ প্রসারের উদ্দেশ্যে জয়কটি মিশনারী স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ইঙ্গ-ভারতীয় কমল বসুর গৃহে প্রথম স্থাপিত হয় জেনারেল এ্যাসেম্বলীজ ইনস্টিটিউশন। বর্তমানে এটিই স্কটিশ চার্চ কলেজ। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ডেমুইট মিশনারীরা 'সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ' প্রতিষ্ঠা করেন। কলিকাতার বাইরে গড়ে ওঠা কতগুলি বিদ্যালয় হলো বোম্বাই-এর ইউলসন কলেজ', মাম্রাজের 'খ্রিস্টান কলেজ' (১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে) মুসলিপত্তমের 'নোব্ল কলেজ' (১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে) আগ্রার ‘সেন্ট জজস্ কলেজ' (১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে) ইত্যাদি।
শিক্ষিত ইংরেজ-জাতির সান্নিধ্য এবং পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের জয়যাত্রা কিছু মানবতাবাদী ভারতীয় ও ইন্ন ভারতীয় ব্যক্তিকে এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে অনুপ্রাণিত করেছিল। এদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে ভবানীপুর ও চুঁচুড়ায় ছটি ইংরেজি ব্যাগ স্থাপিত হয়। রাধাকান্ত দেব, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর, রসময় দত্ত প্রমুখের ঐকান্তিক চেষ্টায় এবং সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হাইড ইস্ট, ডেভিড হেয়ার প্রমুখের আগ্রহে হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা হয় ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার ফলে এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। বর্তমান এটি প্রেসিডেন্সী কলেজ নামে পরিচিত। স্কুলগুলিতে ভাল পাঠ্যপুস্তক সরবরাহের উদেশ্যে 'কলিকাতা স্কুল বুক সোসাইটি' স্থাপিত হয় ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে। ডেভিড হেয়ার নিজস্ব উদ্যোগে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠা স্থাপন করেন যা বর্তমানে হেয়ার স্কুল নামে পরিচিত। রাজা রামমোহন রায় একটি ইংরাজী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
অন্য পোস্ট: জাপানের ২১ দফা দাবি
মার্কুইস অফ হেস্টিংস কর্তৃক ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের ১১ অক্টোবর প্রকাশিত শিক্ষাসংক্রান্ত মিনিট এদেশের মিশনারি কার্যাবলীকে সত্যিকারের উৎসাহিত হয়েছিল। তিনি এই মিনিটে শিক্ষা বিস্তারের মিশনারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা স্বীকার করেছিলেন ।
অন্য পোস্ট : আফিমের যুদ্ধে "লিন সে সুর " ভূমিকা
খ্রিস্টান মিশনারীরা ধর্মকারকে তাদের 'নৈতিক কর্তব্য ও অধিকার' বলে দাবি করেন, এজন্য প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে শিক্ষা প্রসারের উপর জোর দেন। ভারতের হস্তশিল্পের বিনাশসাধন এবং এদেশে ব্রিটেনের কলে প্রস্তুত দ্রব্যাদির নিশ্চিত বাজার গড়ে ওঠার প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ শিল্পপতিদের একাংশও ভারতে ইংরাজী শিক্ষার প্রসারের উপর জোর দেন। কোম্পানির কর্মপরিধি প্রসারিত হওয়ায় লন্ডন থেকে বেশি বেতনে ইংরেজ কর্মচারী আনার পরিবর্তে ইংরেজি জানা ভারতীয়দের নিম্নপদে নিয়োগ করা লাভজনক বলে কোম্পানী বিবেচনা করে।
*** Madhyamik , H.S , B.A , M.A ইতিহাস বিষয়ের উপর নোট পেতে চাইলে নীচে কমেন্ট করুন।
0 Comments
If you like the posts, you must comment. and if there is any problem , please let me know in the comments.