পাশ্চাত্য বিজ্ঞান: ঔপনিবেশিক প্রয়োগ | পশ্চিমি বিজ্ঞানে উদ্ভব ও উনিশ শতকের বাংলায় এর প্রভাব কি ছিল |
ঔপনিবেশিক আধুনিকতার সমালোচনাকে ইতিহাসবিদরা পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের প্রকৃতি ও প্রভাব বিষয়ে প্রশ্ন তোলার অঙ্গনে টেনে নিয়ে গেছেন। ফলে এই প্রথম বিজ্ঞানের ইতিহাস, আধুনিক ভারতীয় ইতিহাসের মূলস্রোতের আখ্যানের এক অঙ্গ হয়ে উঠেছে। আগেকার বিবরণগুলোতে দেখানো হত যে প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানের আধুনিক ইউরোপীয় জ্ঞান আস্তে আস্তে নির্বিরোধে ছড়িয়ে পড়ছে। এখন তার জায়গায় এমন এক বিজ্ঞানের ভাবচিত্র তুলে ধরা হয় যা ‘ঔপনিবেশিক কাঠামোর মধ্যে হাঁসফাঁস করে মরছে, যার পান্না এবং যার ক্রিয়াকর্ম ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব রক্ষার প্রয়োজনের দ্বারা নির্ধারিত ও ব্যাহত হয়, যার সর্বাঙ্গে জাতিবৈষম্যর ছাপ। যেমন ডেভিড আর্নল্ড তো জোর দিয়ে বলেছেন যে, ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান রূপ ধারণ করার পথে জ্ঞানের বিস্তারটা যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, জ্ঞানকে অস্বীকার করাটাও ততখানি গুরুত্বপূর্ণ
সীমিত মাত্রায় পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্তার হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তার "গতি গুরুতরভাবে শ্লথ হয়ে পড়েছিল। এ বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের কথা যদি তোলা যায়, তাহলে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ভূমিকাকে 'হালকা প্রণয়রঙ্গের অস্থির লীলাখেলা' বলে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথম দিকে যা কিছু সাফল্য এসেছিল, সেসবই এসেছিল ব্যক্তিগত বা স্বশাসিত উদ্যোগ মারফত। যেমন ধরা যাক জেমস প্রিন্সেপ-এর কথা। সরকারিভাবে তিনি ছিলেন কলকাতা টাকশালের পরিচালক। কিন্তু তিনিই প্রাচীন ভারতচর্চার পদ্ধতি কালে দেন। গোড়ার দিকে ভারতচর্চায় জোর পড়ত কেবল সাহিত্যিক উৎসগুলির ওপর। তিনি সেখান থেকে সরে এসে পুরাতত্ত্ব, শিলালিপি আর মুদ্রাবিজ্ঞানের চর্চার ওপর জোর দিলেন। শিবালিক অঞ্চলের সমৃদ্ধ জীবাশ্ম-ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন সেনাবাহিনীর একজন এনজিনিয়র ও শল্যচিকিৎসক। এঁরা রাষ্ট্রের কর্মকর্তা হলে কী হবে, এঁদের মননচর্চার ক্ষেত্রগুলি এঁদের সরকারি কর্মভারের চৌহদ্দির VO বাইরে অবস্থিত ছিল। প্রণালীবদ্ধ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ কেবল চারটি ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছিল – মানচিত্র আর জরিপকার্য, উদ্ভিদবিদ্যা, ভূতত্ত্ব আর চিকিৎসাশাস্ত্র। চারটি ক্ষেত্রই ব্রিটিশ আর্থিক ও রাজনৈতিক-সামরিক স্বার্থর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। বিজ্ঞানের যেসব শাখার তাৎক্ষণিক ব্যবহারিক প্রয়োগের সম্ভাবনা কম, সেগুলোকে অবহেলা করত রাষ্ট্র – যেমন গণিত, পদার্থবিজ্ঞান আর রসায়ন। তবে লক্ষণীয়, উনিশ শতক পেরিয়ে বিশ শতকে প্রবেশের সময় এই ক্ষেত্রগুলিকে বিকশিত করে তুলেছিল ভারতীয়রাই।
"ব্রিটিশ বণিক, কর্মকর্তা আর সৈন্যদের থাকতে হত অপরিচিত এক আবহাওয়ায়, তার ওপর যুদ্ধ তো লেগেই ছিল। কাজেই নিছক টিকে থাকার জন্যই আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে চর্চা অপরিহার্য হয়ে পড়ল। আদতে ১৭৬০-এর দশকে বাংলায় যার সূত্রপাত, সেটাই পরে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিস-এর রূপ ধারণ করেছিল (এই জিনিসটা একেবারে নিখাদ ঔপনিবেশিক উদ্ভাবন, এর কোনো পূর্বসূরি নেই- না প্রভুদেশে, না ভারতে)। ১৮৫৫ থেকে পরীক্ষা মারফত এই সার্ভিসে লোক নিয়োগ শুরু হয়। বিশ শতকের গোড়ার দিক অবধি এই সার্ভিস প্রায় পুরোপুরিই ইউরোপীয়-অধ্যুষিত ছিল। তবে অধস্তন পদগুলিতে 'নেটিভ' সহকারীর প্রয়োজন দেখা দেওয়ায় দ্রুত মেডিক্যাল কলেজগুলোর পত্তন হয়, যার মধ্যে প্রথমটি স্থাপিত হয় কলকাতায় ১৮৩৫ সালে। প্রথম প্রথম বিভিন্ন ধরণের দেশি চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে কিছুটা আগ্রহ থাকলেও, ক্রমে তার জায়গা অনেকটাই নিয়ে নিল রোগনির্ণয় আর মহামারীর এক নতুন পরিবেশগত প্যারাডাইম, যা দীর্ঘদিন ধরে প্রাধান্য বিস্তার করে রইল। দেশজ চিকিৎসার অভিজ্ঞতা আর জ্ঞানকে ছোটো চোখে দেখা হতে লাগল। অথচ একই সঙ্গে ভারতীয় জলবায়ুর তথাকথিত অদ্ভুত সব বৈশিষ্ট্য, যা নাকি তথাকথিত অস্বাস্থ্যকর সব অসুখের জনক, তার ওপর পূর্ণমাত্রায়, এমনকি অতিরিক্ত মাত্রায়, জোর দেওয়া হল। যার ফলে ট্রপিক্যাল মেডিসিন' নামে একেবারে ভিন্ন গোত্রের স্বতন্ত্র এক বর্গর উদ্ভব হল, যে-বর্গ একমাত্র ভারতের প্রতিই প্রযোজ্য। এরই দৌলতে রোগের জীবাণুতত্ত্ব ব্রিটিশ ভারতে স্বীকৃত হতে অনেক দেরি হয়ে গেল। কলকাতার এক জলাধারে কলেরা ব্যাসিলাস খুঁজে পেয়েছিলেন কখ, কিন্তু তখনকার মেডিক্যাল প্রতিষ্ঠান সে- আবিষ্কারকে পাত্তা দেয়নি অনেক দিন। ম্যালেরিয়ার কারণ হিসেবে জলবায়ুর অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যকে দায়ী করা হত। একই ভাবে বহু ভারতীয়র (বিশেষ করে বাঙালিদের, যারা 'বর্ধমান জ্বরে' কেবলই কাবু হয়ে পড়ত) শীর্ণ চেহারার জন্য দায়ী করা হত ওই জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যগুলোকেই। এক বিশেষ প্রজাতির মশার সঙ্গে ম্যালেরিয়ার যে সম্পর্ক আছে, সে বিষয়ে রোনাল্ড রস-এর অত বড়ো আবিষ্কারকে বিশেষ কোনো মদত বা স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এদিকে জনস্বাস্থ্যর জন্য রাষ্ট্র অতি সামান্য টাকা বিনিয়োগ করত। আধুনিক হাসপাতাল জিনিসটাকে বেশির ভাগ লোক একটা মরণ ফাঁদ বলে ভয় পেত। হাসপাতালগুলো গরিবদের শুশ্রূষা নিয়ে মাথা ঘামাত না, আর সাধারণভাবে ছিল অস্বাস্থ্যকর।
প্রথম থেকেই উদ্ভিদবিদ্যায় ঔপনিবেশিক আগ্রহের নির্ভেজাল নিদর্শন হল। কলকাতার কাছে শিবপুর উদ্ভিদ উদ্যান, যা স্থাপিত হয়েছিল ১৭৮৬ সালেই। এর " পর উত্তরপ্রদেশের উত্তরাঞ্চলে সাহারানপুরে এবং আরো কিছু কিছু জায়গায় গড়ে চার ওঠে গবেষণাকেন্দ্র। কোন কোন কৃষিজ পণ্য রপ্তানি করার সুযোগ আছে, সেই আগ্রহই এর মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছিল। অনুরূপভাবে, ১৮৫১ সালে জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া স্থাপনার মূলেও ছিল খনিজ সম্পদের, বিশেষ করে কয়লার চাহিদা, যা রেল চালানোর জন্য অপরিহার্য। রেলপথের জন্য প্রচুর কাঠ লাগত আর বহুলাংশে সেই চাহিদা মেটানোর তাগিদেই ১৮৬৪ সালে গঠিত হয় অরণ্য বিভাগ যা শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের মোট ভূভাগের প্রায় কুড়ি ভাগকে অধীনে রাখত বা নিয়ন্ত্রণ করত।" এই উপমহাদেশের সবচেয়ে বড়ো ভূ-ব্যবস্থাপক ছিল এই অরণ্য বিভাগ। এই বিভাগের প্রশাসনের, এবং যেভাবে সেই প্রশাসন রাষ্ট্রীয় “ নীতিকে ব্যাখ্যা করত, তার নানাবিধ বাস্তুতান্ত্রিক, আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক তাৎপর্য ছিল। পরের অধ্যায়গুলিতে এ বিষয়টি আমরা বিশেষ মনোযোগ সহকারে অনুধাবন করব।
তবে ঔপনিবেশিক শাসকদের বিজ্ঞাননীতির সঙ্গে, বিশেষ করে ঔপনিবেশিক ক্ষমতা-জ্ঞানের স্বার্থে, তাদের বস্তুগত, ব্যাবহারিক ও মতাদর্শগত সংযোগের নির্ধারক মাত্রাগুলোকে অতিসরল করে দেখার একটা সম্ভাবনা আছে। ম্যাথিয়ু এড্নি উপনিবেশের ভূগোলচর্চা নিয়ে যে-গবেষণা করেছেন তা থেকে বোঝা যায়, এই বিশাল উপমহাদেশটিকে কার্যকরভাবে শাসন ও শোষণ করার পূর্বশর্ত ছিল মানচিত্র আঁকার ও ভৌগোলিক পরিসর পরিমাপ করার প্রকরণের বিকাশ ঘটানো। রেনেল-এর আঁকা বাংলার, অতঃপর ভারতের মানচিত্র থেকে শুরু করে ১৭৭০ আর ১৭৮০-র দশকে মানচিত্র আঁকার প্রয়াসে দুটি পর্ব ছিল। পায়ে-চলা পথের ভৌগোলিক দূরত্ব মেপে যাত্রাপথের জরিপ করা হত আর তারই সঙ্গে মেলানো হত কম্পাসের সূচক-রিডিংকে। উনিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে আরো বিমূর্ত আরো বিজ্ঞানসম্মত ট্রিগোনোমেট্রি-ভিত্তিক জরিপের পদ্ধতি চালু হয়। কম্পাসের সূচক ধরে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গার ভৌগোলিক দূরত্ব চেন দিয়ে মাপার প্রয়োজন আর রইল না। তার বদলে পাহাড়ের মাথা থেকে কিংবা মিনারের চূড়া থেকে কোনো জায়গার কৌণিক দূরত্ব মেপে নিয়ে, একটা ‘বেস লাইন' মেপে নিয়ে, তারপর তার ভিত্তিতে একের পর এক কাল্পনিক ত্রিভুজমালার অন্যান্য ভুজগুলোর দৈর্ঘ্য অঙ্ক কষে বার করে নেওয়া হত। উনিশ শতকে বেন্থাম সার্বিক শাসনের যে-সর্বাত্মক বীক্ষণের কল্পনা করেছিলেন, স্পষ্টতই তার সঙ্গে এই ত্রিভুজমালা-পরিমাপের সম্পর্ক আছে। ফুকো এই জিনিসটাকেই শৃঙ্খলবদ্ধ নিয়ন্ত্রণের আদর্শ কল বলেছিলেন। যেমন এক্ষেত্রে উঁচু উঁচু স্থানে অধিষ্ঠিত ব্রিটিশ সার্ভেয়ররা যেন অনেক ওপর থেকে-দেখা পরিসরের এক প্রভুত্বকারী, শাসনকারী দৃশ্য রচনা করতেন। কিন্তু এড়নি দেখিয়েছেন যে 'এই আদর্শ সর্বাত্মক বীক্ষণপন্থী জরিপ কার্যক্ষেত্রে রূপায়িত করার সাধ আর সাধ্যের মধ্যে মাঝে মাঝেই বড়ো বড়ো ফাঁক থাকত, সংঘাত ও বাধত। আধুনিকতাবাদী বীক্ষণ 'কখনোই অতখানি সর্বগ্রাসী .. অতখানি কার্যকর হতে পারত না।' এই ত্রিভুজমালা- পরিমাপের খরচ অনেক, ← সে তুলনায় টাকার জোগান প্রায়ই বেশ কম ছিল। স্থানীয় সংবাদদাতাদের সঙ্গে মাঝেমাঝেই বোঝাপড়া আর আপোস করতে হত। সামরিক অভিযান চালানো আর ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্তর জন্য জরিপের কাজে সর্বভারতীয় টে ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে-র (১৮১৮-৪৩) কার্যকারিতা কিন্তু আগেকার মাটিতে হাঁটা সার্ভের তুলনায় আসলে কম ছিল। তাই, এড্নির মতে ত্রিভুজমালা-পরিমাপের পদ্ধতি বেছে নেওয়ার পিছনে যে-বাধ্যবাধকতাটা কাজ করেছিল তা যত না ব্যাবহারিক তার চেয়ে হয়তো বেশি মতাদর্শগত। এর সঙ্গে সবচেয়ে বড়ো সম্পর্কটা ছিল ব্রিটিশদের আত্ম-প্রতিচ্ছবির। তারাই যে শাসক উচ্চবর্গ, তারা যে সার্বিক নজরদারি আর নিয়ন্ত্রণের জায়গায় আছে, এই আত্মবিশ্বাসটাকে জোরদার করার কাজে এটা সহায়ক ছিল। নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার কতকগুলি ধরণ ভারতীয়দের সম্বন্ধে ঔপনিবেশিক শাসকদের ধ্যানধারণাগুলোকে নির্দেশিত করত। এর সঙ্গে কিন্তু প্রভুদেশের শাসকশ্রেণীর পুরুষরা তাদের নিজের দেশে শ্রমিক আর নারীদের প্রতি যে-মনোভাব পোষণ করত, তার বিশেষ ফারাক ছিল বলে মনে হয় না। অন্তত উনিশ শতকের গোড়ার দিক সম্বন্ধে একথাটা বলা যেতেই পারে। এতসব দ্বিধা সত্ত্বেও এড্নি কিছু মনে করেন যে মানচিত্র আঁকার পদ্ধতিতে ঔপনিবেশিক-পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিক জ্ঞান আরোপ করার ফলে ওই ক্ষেত্রে বেশ জোরালো ‘আধুনিকতামুখী’ ধাক্কা লেগেছিল। তাঁর এই মত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কপিল রাজ। তাঁর বক্তব্য হল, প্রভুদেশের আর উপনিবেশের সমমাত্রিক ঘটনাবলির বিকাশের পথগুলি পরস্পরের মধ্যে মিশে গিয়ে সংকরায়ণের কিছু উপাদান তৈরি হয়ে উঠেছিল। তিনি এই বিষয়টার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যে, রেনেল যখন ১৭৬০-এর দশকে বাংলার বিশাল বিশাল জরিপ মানচিত্র আঁকতে শুরু করেন, তখন কিন্তু ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের কোনো সুষম বা বিস্তারিত মানচিত্র ছিল না। কাজেই আগে থেকেই তৈরি একটা আস্ত পাশ্চাত্য মডেলকে ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। রাজ জোর দিয়েছেন স্থানীয় সংবাদদাতাদের ভূমিকার ওপর, এমনকি তাদের কাজের পদ্ধতির ওপর। এগুলো সবই একটা ছাঁদের মধ্যে আধারিত হয়েছিল। তিনি এর নাম দিয়েছেন 'বিষমমাত্রিক পারস্পরিকতা' (অ্যাসিমেট্রিক রেসিপ্রোসিটি)।
অন্য পোস্ট: জাপানের একুশ দফা দাবি
উনিশ শতকের শেষ দিক আর বিশ শতকের প্রথম দিক থেকে বিজ্ঞান যে সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, তার নানান লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায়। আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনকে আরো কেন্দ্রীভূত করে তোলার তাগিদ জোরদার হয়ে ওঠে, যার ফলে আরো বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াপদ্ধতি আমদানি করার, এমনকি একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রে পদ্ধতি উদ্ভাবন করার, প্রয়াস দেখা দিল। একটি গবেষণাতে আরো অনেক বেশি ব্যক্তিগত স্তরে নজরদারি চালানোর বহু নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভবের ধারাটি অনুসরণ করা হয়েছে। এ ধরণের নজরদারি প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়েছিল, তার কারণ ঔপনিবেশিক আমলের শেষ দিকে লোকের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে আস্তানা গাড়ার প্রবণতা অনেক বেড়ে যাওয়ায় সচলতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এর ফলে দেখা দিয়েছিল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার ভয়। যেমন রেলগাড়ি মানুষের চলাচলে সত্যিই একটা বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিল। এর দরুন শহরে, খনিতে, বাগিচায়, এমনকি বিদেশে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক যাতায়াত করতে লাগল। বিভিন্ন ধরণের পরিস্থিতিতে ব্যক্তিপরিচয় যাচিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন দেখা দিল। বড়ো বড়ো শহরে জন্মমৃত্যুর নিবন্ধীকরণ চালু হয় ১৮৭০-এর দশকে, বিশেষ করে যেহেতু আগের তুলনায় সুসংগঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে প্রায়ই বয়সের প্রমাণ দেখাতে হত। চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের জন্য ১৮৬০-এর দশকে আর কয়েদিদের চালান দেবার জন্য ১৮৭৫-এ চালু হয় আলোকচিত্র তোলার প্রথা। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, অপরাধ নির্ণয় আর প্রমাণের জন্য বাংলার পুলিশ ১৮৯০-এর দশকে আঙুলছাপ নেওয়ার পদ্ধতি উদ্ভাবন করে। জলপাইগুড়ির এক চা বাগিচা মালিকের খুনের মামলায় দোষ প্রমাণ করার জন্য ১৮৯৮ সালে তারা এ পদ্ধতি প্রথম কাজে লাগায়।" এরই পাশাপাশি ১৮৯০আর ১৯০০-র দশকে মহামারী আর দুর্ভিক্ষের বন্যা বয়ে যায়। ফলে প্রশাসন সক্রিয়ভাবে জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে বাধ্য হয়। কখনো কখনো সে সক্রিয়তা অবনীয় অলমে পর্যবসিত হত। -ভাবিত প্লেগ-সিকাম .. তখনই ব্যাপকভাবে কাজে লাগে। এরই সঙ্গে যুক্ত হয় প্লেগ আক্রান্ত ব্যক্তিটিকে বিচ্ছিন্ন করে রাখবার জন্য আসুরিক সব পদ্ধতি, যা ভারতীয়দের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ, এমনকি কখনো কখনো সহিংসতারও জন্ম দেয়। এতদ্সত্ত্বেও কার্জন ভারতে পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের মতাদর্শগত উপকারিতার গুণকীর্তন করা থামাননি। অবশ্য কার্জনকে কোনো ব্যাপারেই থামানো সহজ ছিল না। ১৮৯৯-এ একটি চিকিৎসাবিজ্ঞান অধিবেশনে তিনি সর্বসমক্ষে ঘোষণা করেন যে ব্রিটিশরা ভারতকে যেসব ‘উপহার’ দিয়েছে, তার মধ্যে আইন, খ্রিস্টধর্ম আর সাহিত্য নিয়ে যদি-বা কোনো প্রশ্ন ওঠে, বিজ্ঞান নিয়ে, বিশেষত চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে, কখনো কোনো প্রশ্ন উঠবে না। কেননা, তিনি জানান, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভিত্তি হল ‘বিশুদ্ধ, অকাট্য, কঠিন বিজ্ঞান।' কোনোরকম 'অশ্রদ্ধা' প্রদর্শন না করে কিংবা বিহিত আচারভঙ্গ' না করেই তা পর্দাপ্রথা আর জাতপাতের বাধা দূর করতে সক্ষম। তাঁর মতে, ব্রিটিশ শাসনের সপক্ষে সবচেয়ে বড়ো যুক্তি হল চিকিৎসাবিজ্ঞান।"
সাম্রাজ্যের প্রাতিষ্ঠানিক বৈজ্ঞানিক কাঠামোটি ছিল গভীরভাবে জাতিবিদ্বেষী। বৈষম্য আর দূরে সরিয়ে রাখার প্রথা ব্যাপক ছিল। ভারতের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান আর ভারতের পদ্ধতিগুলোকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হত। যেসব ভারতীয় কিছু বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণ লাভ করার সুযোগ পেয়েছিল, যাদের সংখ্যাটা ক্রমেই বাড়ছিল, তাদের কাছে এ ব্যাপারটা উত্তরোত্তর বিরক্তিকর হয়ে উঠছিল। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ যখন রাষ্ট্রের বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে যোগ দিতে চাইলেন, তখন এই বৈষম্যের ব্যাপারটা আরো প্রকট হয়ে উঠল। প্রমথনাথ বসুর ঘটনাটা সুবিদিত। তিনি লন্ডন থেকে ভূতত্ত্বে ডিগ্রি নিয়ে ফেরেন, কিন্তু জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াতে তাঁর কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে, কারণ উক্ত প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক সন্দেহ করতেন যে ‘একজন বাঙালি হিসেবে ... তিনি হয়তো ওই কাজের পক্ষে শারীরিকভাবে অক্ষম।' ১৯০৩ সালে চাকরি ক্ষেত্রে বসুর চেয়ে দশ বছরের ছোটো একজন ইংরেজকে যখন ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পদে বসানো হল, তখন বসু পদত্যাগ করেন। পরে তিনি টাটাদের জামশেদপুরের ইস্পাত কারখানার জন্য ওড়িশার কেওনঝর-এ লোহার খনি আবিষ্কার করেন। তবে উপনিবেশবিরোধী জাতীয়তাবাদের যুগে পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের প্রতি শিক্ষিত ভারতীয়দের মনোভাব স্বভাবতই খুব বিমিশ্র ছিল, তা সামগ্রিক প্রত্যাখ্যানের পথে যায়নি। একটু পরেই আমরা সেটা দেখতে পাব।
0 Comments
If you like the posts, you must comment. and if there is any problem , please let me know in the comments.