সামুরাই| সামুরাই এর ইতিহাস
জাপানের সমাজে পেশাদার যোদ্ধা শ্রেণীকে সামুরাই বলা হত। জাপানের সামাজিক কাঠামোয় সামুরাই বা যোদ্ধা শ্রেণীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। জাপানি জনসংখ্যার এক ষষ্ঠাংশ ছিল এই শ্রেণীর অন্তর্গত। তরবারি এই শ্রেণীর প্রতীক। দ্বাদশ শতকে যখন মিনা মোটো ও ভায়রা গোষ্ঠীর মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল তখন এই শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছিল বলে অনেকে মনে করে থাকেন। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই শ্রেণীরও পরিবর্তন ঘটেছিল। প্রথমদিকে এই শ্রেণী যুদ্ধ ছাড়াও কৃষিকাজ করত। তারা যোদ্ধা ও কৃষক হিসাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত ছিল। যুদ্ধের সময় তারা যুদ্ধ করত এবং যখন যুদ্ধ থাকত না তখন তারা কৃষিকাজ করত। কিন্তু সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ বেড়েছিল। রণকৌশল জটিল হয়েছিল। পরিণতিতে সামুরাই শ্রেণী কৃষিকাজ ছেড়ে যুদ্ধকেই পেশা হিসাবে গ্রহণ করেছিল। ডাইমোদের জমিদারি এলাকায় শান্তিরক্ষার দায়িত্ব তাদের ওপরে ছিল। দুর্গরক্ষার দায়িত্ব তাদের ছিল। সবসময় তাদের প্রভুর কাছাকাছি থাকতে হত। কৃষিকাজ করার কোনো অবকাশ তাদের ছিল না। জমিদারেরএলাকায় শাস্তি বজায় রাখার বিনিময়ে সামুরাই শ্রেণী দ্রব্যের মাধ্যমে কিংবা অর্থের মাধ্যমে তাদের পারিশ্রমিক পেত। খাদ্য, পোশাক, শিক্ষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে সামুরাই শ্রেণী এক নির্দিষ্ট আচরণ-বিধি মেনে চলত। সামুরাই শ্রেণীর মধ্যেও স্তরবিন্যাস ছিল। স্তর অনুযায়ী তাদের কাজ করতে হত। উক্ত পর্যায়ভুক্ত সামুরাই শ্রেণী গ্রামীণ শাসনের সঙ্গে জড়িত ছিল এবং তারা গ্রামীন শাসনের নীতি নির্ধারক ছিল। তারা আর্থিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করত। কিছু কিসামুরাই সংবাদ আদান-প্রদান, দুর্গ রক্ষা ইত্যাদি করত।
এই শ্রেণী ছিল সমাজে বীরত্বের প্রতীক। টোকুগাওয়া শোগুনযুগে একজন সামুরাই দুটি তরবারি রাখত। একটি ছোটো এবং অন্যটি বড়ো। ছোটো তরবারি ঢাকা থাকত এবং বড়ো তরবারিটি যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা হত। সামুরাইদের তরবারির প্রতি জাপানিদের শ্রদ্ধা দেখার মতো ছিল। জাপানি সমাজে এই শ্রেণীর মর্যাদা ছিল অনেক বেশি। ওই যুগে জাপানে যে বৃত্তিকে সবচেয়ে বেশি সম্মান দেওয়া হত, তা হল সামগ্রিক বৃত্তি। সামুরাই শ্রেণী ছিল আত্মমর্যাদার প্রতীক। এদের কাছে সম্মান ছিল জীবনের চেয়েও মূল্যবান। অসম্মানীয় জীবন তাদের কাছে মৃত্যুর শামিল ছিল। বিশ্বাসঘাতকতা, যুদ্ধে পরাজয়, প্রচুর বিরাগভাজন, এসব ছিল সামুরাইদের জীবনদর্শনের বাইরে। আত্মগ্লানিকে তারা সহ্য করতে পারত না। আত্মমর্যাদাহীন ও বিড়ম্বিত জীবনের চেয়ে তারা মৃত্যুকে হাসিমুখে বরণ করত। হারাকিরি ছিল মৃত্যুর পদ্ধতি। সাধারণত ধর্মমন্দিরে তারা হারাকিরি করত। হারাকিরি করা সামুরাইদের সব সম্পত্তি সরকার বাজেয়াপ্ত করত। পরবর্তীকালে অবশ্য এই নীতির পরিবর্তন হয়েছিল। হারাকিরি করা সামুরাইদের সম্পত্তি তাদের আত্মীয়দের হাতে তুলে দেওয়া হত।
জাপানের ঐতিহ্যগত নিশ্চল সমাজজীবনে সামুরাই শ্রেণীর এক অনবদ্য ভূমিকা ছিল। এই শ্রেণী ছিল ভদ্র, শিক্ষিত ও সংস্কৃতিচেতনাসম্পন্ন। তারা সামরিক শৌর্য ও গাণ্ডিত্যের মেলবন্ধন ঘটিয়েছিল। তারা সমাজে এক সুনির্দিষ্ট নীতিকে মেনে চলত। তাদের কী করা উচিত এবং কী করা উচিত নয়, তা নির্ধারণ করার জন্য বুশিদো (Bashido) বা নীতি সংহিতা তৈরি করা হয়েছিল। বুশিদো শব্দের অর্থ হল 'যোদ্ধার পথ'। এই নীতি সংহিতায় কনফুসীয় আদর্শকে বেশি স্থান দেওয়া হয়েছিল। উদারতা, আনুগত্য, গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা, এইসব কনফুসীয় নীতিকে গ্রহণ করা হয়েছিল। একজন সৈনিকের অবশ্য পালনীয় কর্তব্যকে এখানে স্থান দেওয়া হয়েছিল। সামুরাই সেণী এই সংহিতাকে মেনে চলেছিল। সামুরাইদের কাছে সম্মান ছিল জীবনের থেকেও মূল্যবান। এই সম্মানকে বজায় রাখার জন্য তাদের কাছে মৃত্যু ছিল খুবই তুচ্ছ ব্যাপার। যে সব সামুরাই-এর প্রভু থাকত না, তাদেরকে বলা হত রোনিন (Ronin)। নানা কারণে সামুরাই শ্রেণী প্রভৃহীন হয়ে পড়ত। কোনো নিঃসন্তান প্রভুর মৃত্যু হলে, শোগুনের নির্দেশে কোনো জমিদার জমি হারালে কিংবা জমিদারের জমি কোনোকারণে হস্তান্তরিত হলে সামুরাই শ্রেণী তখন রোনিনে পরিণত হত। কোনো জমিদার সামুরাইদের বিতাড়িত করলে তারাও রোনিন হয়ে পড়ত। সমাজে এই রোনিন সামুরাইদের কী ভূমিকা ছিল, তা রিচার্ড স্টোরি বিশ্লেষণ করেছেন।
আফিমের যুদ্ধে লিন সে সুর ভূমিকা
টোকুগাওয়া শোগুনতন্ত্রের যুগে দুই একটি কৃষক বিদ্রোহ ছাড়া মোটের ওপর জাপানে শান্তি বজায় ছিল। স্বাভাবিকভাবে দেশে শান্তি অব্যাহত থাকায় সামুরাই শ্রেণীর প্রকৃত যে কাজ অর্থাৎ যুদ্ধ করা, তার তেমন প্রয়োজন হয়নি। পেশাদার যোদ্ধা হিসাবে এই শ্রেণীর অস্তিত্ব তখন মূল্যহীন হয়ে পড়েছিল। কর্মহীন সামুরাই শ্রেণীকে বিভিন্ন শাসনতান্ত্রিক কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিল। অনেক সামুরাই যুদ্ধ ছেড়ে বুদ্ধিজীবী, শিল্পমালিক ও বণিকে পরিণত হয়েছিল। আবার অনেকে ভাতাভোগী' শ্রেণীতে রূপান্তরিত হয়েছিলে।
শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান অনেক সামুরাই যুদ্ধহীন হয়ে সংস্কৃতিচর্চা শুরু করেছিলেন। কর্মহীন সামুরাইরা বিদ্যাচর্চার দিকে মন দিয়েছিলেন। তাঁরা কোজিকি ও নিহোনজি নামক জাপানের প্রাচীন ইতিহাসকে পুনরায় সংকলিত করেন। এর ফলে জাপানে রেনেসা বা নবজাগরণ এসেছিল। সামুরাই শ্রেণী দেখিয়েছিলেন যে প্রাচীনকালে জাপানের প্রকৃত শাসক ছিল স্বয়ং সম্রাট, শোগুন নয়। তাঁরা বলেছিলেন প্রাচীন যুগে যখন সম্রাট স্বয়ং জাপানকে শাসন করেছিলেন, তখন জাপানিরা এক সুন্দর মনোরম পরিবেশে দিনযাপন করত। সামুরাইদের এই বক্তব্য সাধারণ মানুষের মনে সম্রাটের প্রতি শ্রদ্ধাকে বাড়িয়েছিল এবং শোগুনের প্রতি তাদের মনে বিদ্বেষ জন্মেছিল। এর ফলে সম্রাটের ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্র বা রেস্টোরেশনের পটভূমিকা তৈরি হয়েছিল। বিদ্যাচর্চা বৃদ্ধির সাথে সাথে সামুরাই সহ বেশ কিছু জ্ঞান অন্বেষণকারী ব্যক্তি ওলন্দাজদের মাধ্যমে পাশ্চাত্য দুনিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে অবগত হয়েছিল। তারা জাপানকে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করার স্বপ্ন দেখেছিল। টোকুগাওয়া শোগুনতন্ত্রের অবসানে ও মেইজি রেস্টোরেশনের পিছনে সামুরাই শ্রেণীর ভূমিকাকে তাই অস্বীকার করা যায় না।
0 Comments
If you like the posts, you must comment. and if there is any problem , please let me know in the comments.