মাঞ্চুরিয়া সংকটে জাতিসংঘের ভূমিকা
অন্য পোস্ট: শোগুনেটের পতনের জন্য দায়ী কারণগুলি কী ছিল?
ঐতিহাসিক কারের মতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড়ো ঘটনা হল জাপান কর্তৃক মাঞ্চুরিয়া দখল। চীন মাঞ্চুরিয়াতে জাপানের সামরিক অভিযান প্রতিহত করতে পারেনি। কিন্তু মাঞ্চুরিয়ায় জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চীনা সরকার জাতিসংঘের কাছে নালিশ জানিয়েছিল (১৯৩১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর)। জাতিসংঘের ১১ নং অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে চীন জাতিসংঘের কাছে জাপানের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করেছিল। ১১নং অনুচ্ছেদে বলা ছিল যুদ্ধ ঘোষণার ফলে বা যুদ্ধের হুমকিতে জাতিসংঘের কোনো সভ্য রাষ্ট্র বিপদের মধ্যে পড়ে তাহলে তা উদ্বেগের কারণ বলে গণ্য হবে। সেই সময়ে জাতিসংঘের পরিষদের বৈঠক চলছিল। এই বৈঠকে জাপানের প্রতিনিধি চীনের অভিযোগ অস্বীকার করেছিল। জাপানি প্রতিনিধির বক্তব্য ছিল চীনের কোনো অঞ্চল অধিকার করার কোনো ইচ্ছা জাপানের নেই। চীনা দস্যুদের হাত থেকে জাপানিদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করার জন্য জাপানি সেনারা মাঞ্চুরিয়াতে প্রবেশ করেছে। জাপানিদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হলেই জাপান সেনা সরিয়ে নেবে। এই অধিবেশনে অনেক তর্কবিতর্ক হয়েছিল। ১৫ দিনের জন্য এই অধিবেশন স্থগিত ছিল। এই সময়ে জাপান মাঞ্চুরিয়াতে তার আগ্রাসন আরও বেশি তীব্র করেছিল। মাঞ্চুরিয়া ঘটনাকে কেন্দ্র করে জাতিসংঘ আলোচনার জন্য ১৯৩১ সালের ১৪ অক্টোবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। জাপান এর প্রতিবাদ করেছিল। মার্কিন প্রতিনিধি গিলবার্ট এই আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন। এই আলোচনায় অংশ নিয়েছিল ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালি। এই পাঁচটি দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে মাঞ্চুরিয়া সংকট নিরসনের জন্য একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। এই কমিশনের নেতৃত্বে ছিলেন লর্ড লিটন। সেজন্য এই কমিশনের নাম ছিল 'লিটন কমিশন'।
মনে রাখা দরকার যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে সময়ে জাতিসংঘের সদস্য ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাঞ্চুরিয়াতে জাপানের অগ্রগতি প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে সে জাতিসংঘের সাথে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এসেছিল। এই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অফ স্টেট এক ঘোষণাবাণী প্রচার করে বলেন যে, ওয়াশিংটন সম্মেলনে যেসব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল পূর্ব এশিয়ায় তার বিরোধী কোনো ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য এইসব চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর চেষ্টা করা উচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানকে এই বলে সতর্ক করে দিয়েছিল যে জাপান যদি বলপ্রয়োগের মাধ্যমে পূর্ব এশিয়াতে কোনো পরিবর্তন করতে চায় আমেরিকা তাকে স্বীকৃতি দেবে না।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা
১৯৩২ সালের প্রথম দিকে লিটন কমিশন মাঞ্চুরিয়াতে তদন্তের জন্য এসেছিল। এই সময়ে চীনে জাপান-বিরোধী বিক্ষোভ তীব্র আকার ধারণ করেছিল। কমিশন তদন্ত সমাপ্ত করে ১৯৩২ সালের ২ অক্টোবর তাদের রিপোর্ট পেশ করেছিল। এই রিপোর্ট ছিল বিরাট এক দলিল। এতে চীন-জাপান সম্পর্ককে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। লিটন কমিশন জাপানের সব যুক্তিকে অগ্রাহ্য করেছিল। জাপানের আচরণের নিন্দা করা হয়েছিল। জাপান যে তার তাবেদার রাষ্ট্র 'মাঞ্চকুয়ো' প্রতিষ্ঠা করেছিল তাকে কমিশন মানেনি। কমিশন চীন ও জাপানের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে মারিয়ায় একটি স্বশাসিত রাজ্য প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছিল। কমিশন ১৬ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জাপানের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। ১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় লিটন কমিশনের রিপোর্ট পেশ করা হয়েছিল। উপস্থিত ৪৪টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের মধ্যে ৪২ জন লিটন কমিশনের প্রতিবেদন সমর্থন করেছিল। শ্যামদেশ ভোটদানে বিরত ছিল। এবং জাপান এই কমিশনের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে জাতিসংঘের সভায় এই কমিশনের প্রতিবেদন গ্রহণ করা হয়েছিল। জাপান এর প্রতিবাদস্বরূপ সভাকক্ষ ত্যাগ করেছিল। কিছুদিন পর জাপান জাতিসংঘের সভ্যপদ ত্যাগ করেছিল। কূটনৈতিকভাবে আপান তখন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল।
বাস্তবে দেখা যায় যে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র জাপানের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব দেখালেও জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। আর্থিক সংকটে জর্জরিত ইউরোপের বৃহৎ শক্তিবর্গ সেই মুহূর্তে জাপানের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে রাজি ছিল না। সেই সময়ে চীনের সাথে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল খুবই কম। কাজেই এই অল্প বাণিজ্যের জন্য তারা জাপানের বিরুদ্ধে কোনো বড়ো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে চায়নি। ইংল্যান্ডের নিরাসক্ত মনোভাব জাতিসংঘকে জাপানের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে দুর্বল করে দিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাও ছিল মারাত্মক রকমের স্ববিরোধিতায় ভরা। আসলে সে সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের প্রধান অংশীদার ছিল জাপান। তাই জাপানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের মৌখিক হুমকি জানালেও আমেরিকা কিন্তু জাপানের সাথে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে রাজি ছিল না। সেই সময়ে জাপানের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হলে সম্মিলিত ব্রিটিশ ও মার্কিন নৌবহরের উপস্থিতি প্রয়োজন ছিল। যেহেতু কোনো শক্তি জাপানের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে রাজি ছিল না সেইহেতু জাতিসংঘের পক্ষে জাপানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। মাঞ্চুরিয়া সংকটের সময় জাতিসংঘ যে দুর্বলতা প্রকাশ করেছিল তার ফলে জাতিসংঘের মর্যাদা বেশ ক্ষুণ্ণ হয়েছিল তা বলা চলে। এই ঘটনা জাতিসংঘের মর্যাদাকে হ্রাস করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল।
জাপানের সম্প্রসারণ :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদী জাপান মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ করলে আবার আন্তর্জাতিক রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। বিশ্বের দরবারে জাপান খলনায়কে পরিণত হয়েছিল। জাপানের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠেছিল যে জাপান জাতিসংঘের সনদ ভেঙেছে এবং কেলা রিয়া ও ওয়াশিংটন সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে মাঞ্চুরিয়া দখল করেছে। বিশ্ব রাজনীতি উত্তপ্ত হলেও বাস্তবে জাপানের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা জাতিসংঘ গ্রহণ করতে পারেনি। স্বাভাবিক কারণে জাপান আত্মবিশ্বাসে ভরপুর হয়ে সম্প্রসারণবাদ নীতি অনুসরণ করেছিল।
মাঞ্চুরিয়া দখল করেও জাপানের সাম্রাজ্য ক্ষুধা এতে মেটেনি। জাপানিরা সমগ্র চীনকে পদানত করার চেষ্টা করেছিল। জাপানের আগ্রাসনে ক্ষুব্ধ চীনারা জাপানি পণ্য বয়কট করেছিল। চীনে অবস্থিত জাপানিদের সম্পত্তি লুণ্ঠন করা হয়েছিল। নানকিং, সাংহাই, হ্যানকাও প্রভৃতি অঞ্চলে জাপান-বিরোধী সংঘ গড়ে উঠেছিল। চীনাদের হাতে একদল জাপানি সন্ন্যাসী সাংহাইতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। জাপানি সেনারা চীনাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য চীন আক্রমণ করেছিল। ব্রিটিশদের মধ্যস্থতায় জাপান তখন চীন থেকে সৈন্য সরিয়ে নিয়েছিল। বিনিময়ে চীন জাপানের সঙ্গে স্বাক্ষর করেছিল সাংহাই যুদ্ধবিরতি চুক্তি। এই চুক্তি সত্ত্বেও চীন-জাপানের সম্পর্ক আদৌ ভালো হয়নি। জাপান সমগ্র উত্তর চীনের ওপর নিজের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছিল। আসলে মাঞ্চুরিয়া দখল করার পরও জাপানের অর্থনৈতিক সমস্যার খুব একটা সমাধান হয়নি। উত্তর চীনের প্রাকৃতিক সম্পদ জাপানকে আকর্ষিত করেছিল। উত্তর চীনের তুলো, লোহা, কয়লা জাপানের শিল্পায়নের পক্ষে অনুকূল ছিল। ওখানকার বিস্তৃত বাজার জাপানি পণ্য বিক্রির সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করেছিল।
আফিমের যুদ্ধে " লিন- সে- সুর " শেষ হলে ভূমিকা
আপানের তখন প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল বলশেভিক সোভিয়েত রাশিয়া। ইতিপূর্বে মাঞ্চুরিয়া আক্রমণকে সোভিয়েত রাশিয়া নিন্দা করেছিল। চীনের সাথে সোভিয়েত রাশিয়ার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সেজন্য জাপান ১৯৩৬ সালের ডিসেম্বর মাসে জার্মানির সঙ্গে Anti Comintern Pact' স্বাক্ষর করেছিল। জাপানের রুশ ভীতির যথার্থ কারণ ছিল। সোভিয়েত রাশিয়া প্রচুর সেনা পূর্ব এশিয়াতে মোতায়েন করেছিল। সোভিয়েত রাশিয়া ১৯৩৫ সালের সপ্তম কমিন্টার্ন কংগ্রেসে ঘোষণা করেছিল যে তার সবচেয়ে বড়ো শত্রু হল দুই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র জার্মানি ও জাপান। তাই জাপান সাম্যবাদী রাশিয়াকে জবাব দেওয়ার জন্য Anti Comintern Pact স্বাক্ষরে বাধ্য হয়েছিল।
১৯৩৭ সালে নতুন উদ্যমে জাপান চীনের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়েছিল। ১৯৩৭ সালের ৭ জুলাই মার্কো পোলো সেতুতে জাপানি ও চীনা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল। এই সংঘর্ষই চীন-জাপান যুদ্ধের কারণ। যুদ্ধের প্রথম দিকে জাপান বিরাট সাফল্য পেয়েছিল। ১৯৩৭ সালের নভেম্বর মাসে সাংহাই-এর পতন হয়েছিল এবং ডিসেম্বর মাসে চীনের রাজধানী নানকিং-এর পতন হয়েছিল। ১৯৩৮ সালে জাপান ক্যান্টন দখল করেছিল। জাপানি আক্রমণের পরিণতিতে পিকিং, ভিয়েনসিন, উহান তার নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল।কিন্তু জাপানের বিরুদ্ধে চীনারা প্রতিরোধ শুরু করেছিল। চীনারা জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। জাপানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য KMT ও CCP দল নিজেদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ বন্ধ রেখেছিল। চীনের রাজধানী চুংকিং-এ স্থানান্তরিত হয়েছিল। চীনাদের প্রবল প্রতিরোধের জন্য জাপান সমগ্র চীনকে নিজেদের কুক্ষিগত করতে পারেনি। মাও-সে-তুঙের নেতৃত্বে চীনা কমিউনিস্টরা প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু করে উত্তর চীনের বেশ কিছু অঞ্চলের উপর তাদের প্রভুত্ব স্থাপন করেছিল। চীনের প্রবল প্রতিরোধের জন্য চীন-জাপান যুদ্ধে ১৯৩৯ সালে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। জাপান সমগ্র চীনকে যেমন দখল করতে পারেনি, তেমনি চীনও জাপানকে বিতাড়িত করতে পারেনি। এই সময় জাপান কূটনৈতিকভাবে চীনের ওপর তার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছিল। সে চীনকে অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়ার কথা বলেছিল। একই সঙ্গে জাপান চীনের সাথে রাজনৈতিক সখ্যতার কথা বলেছিল। জাপান চীনে একটি বিকল্প অনুগত সরকার গঠনের প্রয়াসী হয়েছিল। এ ব্যাপারে জাপান ডাঃ সান-ইয়াৎ সেনের সহযোগী ওয়াং-চিং-ওয়াই-এর সাহায্য পেয়েছিল। ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে নানকিং-এ তাঁর নেতৃত্বে জাপান এক বিকল্প সরকার গঠন করেছিল।
১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এই যুদ্ধে জাপান কয়েকটি কারণে অংশ নিতে বাধ্য হয়েছিল। জাপান সংগত কারণে উপলব্ধি করেছিল। যে পূর্ব এশিয়াতে তার প্রধান শত্রু হল সোভিয়েত রাশিয়া। জাপান জার্মানির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে সোভিয়েত রাশিয়াকে চাপে রাখার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ১৯৩৯ সালে জার্মানি নিজেই সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে একটি অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। স্বাভাবিক কারণে জাপান ক্ষুব্ধ হয়েছিল। জাপান আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছিল। ইংল্যান্ড সম্পর্ক স্থাপনে গররাজিও ছিল না। কিন্তু আমেরিকা কোনো মতেই জাপানের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে রাজি হয়নি। জাপানের কূটনৈতিক কৌশল অকেজো হয়ে পড়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দিকে জার্মানির সাফল্য ছিল প্রশ্নাতীত। জাপান জার্মানির ওপর অভিমান ভুলে তার সঙ্গে মৈত্রী স্থাপনে আগ্রহী হয়ে পড়েছিল। ১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জার্মানি ও ইতালির সঙ্গে জাপানের এক ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হয়েছিল। ১৯৪১ সালের প্রথম দিকে জাপান সোভিয়েত রাশিয়ায় সঙ্গেও সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হলে এই দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল (১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসে)। জাপানের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এশিয়ায় বিশেষ করে চীনে তার সাম্রাজ্যকে প্রতিষ্ঠা করা। এই উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করার পথে তার প্রধান অন্তরায় ছিল সোভিয়েত রাশিয়া। এই চুক্তির মাধ্যমে সোভিয়েত রাশিয়ার শত্রুতাকে ঠেকানো গিয়েছিল।
তাইপিং-এবং-বক্সার-বিদ্রোহ-এর মধ্যে-তুলনা-আলোচনা
চীনের ওপর জাপানি আগ্রাসনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানতে পারেনি। চীনের ওপর জাপানের সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণ আমেরিকাকে উদ্বিগ্ন করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল Open Door Policy-র পৃষ্ঠপোষক। কিন্তু জাপানের সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপ মার্কিন নীতির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ ছিল না। মার্কিনিরা চীনকে নানাভাবে যেমন সাহায্য করেছিল তেমন জাপানের বিরুদ্ধে রপ্তানি বন্ধ করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৩৮ সালে জাপানকে বিমান সরবরাহ বন্ধ করেছিল এবং ১৯৪০ সালের মধ্যে জাপানে পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য, লোহা, যুদ্ধ উপকরণ রপ্তানি বন্ধ করেছিল। স্বাভাবিকভাবে মার্কিনিদের ভূমিকা জাপান মানতে পারেনি। জাপানিদের চোখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল তার প্রবল শত্রু। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের সম্পর্ক খারাপ হলেও সেই মুহূর্তে আমেরিকা কিন্তু জাপানের বিরুদ্ধে কোনো প্রত্যক্ষ সংগ্রামে জড়াতে চায়নি। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ার থেকে ইউরোপের ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী ছিল। মার্কিন জনমত যুদ্ধের বিরোধী ছিল। ১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাপান, জার্মানি ও ইতালির মধ্যে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদিত হলে জাপানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ফাটল আরও তীব্র হয়েছিল। জাপান অনুভব করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে কোনো সময়ে আপানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিতে পারে। তাই জাপান একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক বলয় বা Economic Bloc গঠন করার জন্য পূর্ব এশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার ওপর প্রভুত্ব স্থাপনের জন্য অগ্রসর হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের এই প্রচেষ্টাকে মানতে পারেনি। ১৯৪১ সালে রুশ-জার্মান যুদ্ধ শুরু হলে জাপ নিয়ন্ত্রিত মাঞ্চুরিয়ায় রুশ আধিপত্য স্থাপনের সম্ভাবনা দূর হয়েছিল। জাপান ১৯৪১ সালের জুলাই মাসে ইন্দোচীন দখল করেছিল। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, হল্যান্ড প্রভৃতি দেশ জাপানে সমস্ত পণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছিল। জাপানে অতি প্রয়োজনীয় তেল আমদানির পরিমাণ বহু কমে গিয়েছিল। জাপানের কাছে তখন দুটি পথ খোলা ছিল। এক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আপস করা অথবা দুই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া। মার্কিনদের সঙ্গে আপসের পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। আপসের পথে প্রধান প্রতিবন্ধক ছিল চীন। তবুও আলোচনা চলেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত আপানি দৃত এ্যাডমিরাল নসুরা আপস আলোচনায় প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের কাছে ইন্দোচীন ও চীন থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানিয়েছিল। জাপান ইন্দোচীন থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার দাবি মেনেছিল কিন্তু চীন থেকে সেনা সরাতে চায়নি। ফলে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব কর্নেল হাল জাপানের সাথে সমঝোতায় আসতে রাজি হননি। তাই আপসের সম্ভাবনা দূর হয়ে যায়। মার্কিনিদের এই ধারণা হয়েছিল জাপান কোনোভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে সাহসী হবে না। কিন্তু আত্মপ্রত্যয়ে অটল জাপান যুদ্ধকে বেছে নিয়েছিল। ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর পার্ল হারবারে জাপান মার্কিন নৌবহরকে আক্রমণ করলে সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। এই বোমাবর্ষণের দিনকে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ‘একটি কলঙ্কিত দিন' বলে বর্ণনা করেছিলেন। অধ্যাপক উইলফ্রিড ন্যাপ এই দিনটিকে জাপানের পক্ষে 'সর্বনাশা মূঢ়তার দিন' বা 'a day of supreme folly for Japan' বলেছেন। জাপান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস নতুন মাত্রা পেয়েছিল। পার্ল হারবারের ঘটনার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দিকে জাপান বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছিল। পার্ল হারবারে মার্কিন নৌশক্তি ও বিমান শক্তির ক্ষতি করে জাপানিরা ফিলিপিনসে জেনারেল ডগলাস ম্যাকআর্থারের অধীন মার্কিন বিমানবাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। জাপান একে একে ফিলিপিনস, পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, ব্রহ্মদেশ, মালয়, সিঙ্গাপুর সমেত দূরপ্রাচ্যের ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করেছিল। তারপর যুদ্ধের গতি হঠাৎ পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। মিত্রপক্ষ জাপানের বিরুদ্ধে প্রত্যাঘাত শুরু করেছিল। প্রশান্ত মহাসাগরে জাপান পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৪৫ সালের মে মাসে জার্মানি মিত্রপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছিল। জাপানের আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কোনো পথ ছিল না। ১৯৪৫ সালের জুলাই মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড ও সোভিয়েত রাশিয়া পটসডাম সম্মেলনে মিলিত হয়ে জাপানকে নির্দেশ দিয়েছিল যে জাপান যেন নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু জাপান নিঃশর্তে আত্মসমর্পণে ইচ্ছুক ছিল না। জাপানের সমর নেতারা পটসডাম সম্মেলনের ঘোষণাকে মানেনি। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট হিরোশিমায় এবং ১ আগস্ট নাগাসাকিতে দুটি আণবিক বোমা নিক্ষেপ করেছিল। আণবিক বোমার আঘাতে জর্জরিত হয়ে জাপান বিনাশর্তে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৪৫ সালের ২রা সেপ্টেম্বর মিসৌরি নামে মার্কিন জাহাজে আত্মসমর্পণ আনুষ্ঠানিকভাবে হয়েছিল। এর ফলে ১৯০৫ সাল থেকে জাপান যেসব এলাকা দখল করেছিল সেগুলো সবই হারিয়েছিল।
এইভাবে দেখা যায় যে, মেইজি রেস্টোরেশনের পর নবীন জাপান পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। এই সময় পাশ্চাত্য শক্তির অনুকরণে জাপান সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। সে পরপর দুটি যুদ্ধে চীন ও রাশিয়াকে পরাজিত করে তার শক্তির পরিচয় প্রদান করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তার বিস্তৃতির পথকে সুগম করে দিয়েছিল। জাপান প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে তার সাম্রাজ্যকে বহুদুর বাড়িয়েছিল। চীনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জাপান তার ওপর প্রভুত্ব বহুগুণ বৃদ্ধি করেছিল। কিন্তু এতেও জাপানের রাজ্যলিপ্পা মেটেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান মিত্রশক্তির বিপক্ষে যোগ দিয়েছিল। সাম্রাজ্য বিস্তার করতে গিয়ে সে পরাজিত হয়েছিল। দীর্ঘকাল ধরে ধীরে ধীরে যে বিরাট সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল জাপান সবই হারিয়ে ফেলেছিল।
0 Comments
If you like the posts, you must comment. and if there is any problem , please let me know in the comments.